হিরা খাতুন

১৯৯৫ সাল। সবেমাত্র ১৮ বছরে পা দেন হিরা খাতুন। যখন তার বয়স ১২, তখন মারা যান বাবা সোহরাব আলী। মধ্যবিত্ত পরিবার। সাত বোন ও তিন ভাইয়ের সংসারে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে চুকে যায় পড়ালেখার পাঠ। এরপর শুরু কর্মজীবনের।

১৯৯৫ সালের জুন। সরকারি শিক্ষা দফতরে তার চাকরি হয়ে যায়। যোগদান করেন রাজশাহীর তানোর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দফতরে। তখন জানতেনই না তিনি কী পদে চাকরি করছেন। ভাবতেন, হয়তো তিনি অফিসের পিয়ন। যখন জানতে পারেন তিনি অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, তখন অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কেটে গেছে প্রায় ২৫ বছর। নিজের পেশা নিয়ে তাই আক্ষেপ নেই হিরা বেগমের।

তার পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে। কাজের সুবাদে তানোরেই থাকতেন তিনি। চাকরিতে যোগদানের পর রাজশাহী নগরীর টিকাপাড়া খুলিপাড়া বৌবাজার এলাকার নাজমুল হাসানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুই ছেলে-মেয়ে।

ছেলে মো. সিয়াম (২৩) অত্যন্ত মেধাবী। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছেন। রাজশাহীর সরকারি শিরোইল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি করা হয়। তার স্বপ্ন ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু এইচএসসিতে ভালো ফল করতে না পারায় সেই স্বপ্ন নিভেই যাচ্ছিল।

শেষে রাজশাহীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি করেন ছেলেকে। এখন ছেলে অষ্টমে সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। মেয়ে হাসনাহেনা হাসি (১৪) নগরীর পিএন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেধাবী ছেলেমেয়েদের চোখে আগামীর স্বপ্ন দেখেন হিরা খাতুন।

সংসার, সন্তান ও চাকরি নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম হিরা খাতুনের। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, তখন তিনি তানোর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা দফতরে কর্মরত। দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে ছিলেন তিনি। পরে তাকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। ওই সময় তার ছেলে সিয়াম এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তার অনুপস্থিতিতে ছেলে পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মিশে পড়লাখেলা লাটে তোলে। ফলে এইচএসসির ফলাফল সন্তোষজনক হয়নি তার। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি করেন। প্রতিবছর ছেলের পেছনে তার এক লাখ টাকা খরচ হয়।

হিরা খাতুন জানান, তার শাশুড়ি তানোরের মহিলাবিষয়ক দফতরের অফিস সহায়ক ছিলেন। সেখানেই তাকে দেখে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তার স্বামী ছিলেন বেকার। বছর দুয়েক আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। কাজ না থাকায় এখন আবার বেকার। বৃদ্ধা শাশুড়ি ও স্বামী-সন্তানসহ পাঁচজনের পরিবার চলে তার একার আয়ে। শহরে স্বামীর নিজের বাড়ি না থাকলে হয়তো তিনি সন্তানদের পড়ালেখা করতে পারতেন না।

নিজেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন না হিরা খাতুন। বিষয়টি নিয়ে তার কখনো কখনো খারাপ লাগে। কারণ অনেক সহকর্মী প্রকাশ্যে কথা না বললেই আড়ালে অনেক কথাই বলেন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন তিনি।

হিরা বলেন, এটি তার কাজ, পেশা। যোগ্যতা অনুযায়ী তার চাকরি হয়েছে। এরই মধ্যে চাকরি স্থায়ীও হয়েছে। এই কাজটা না করলে তিনি সন্তানদের মানুষ করতে পারতেন না, সংসার চালাতে পারতেন না। কাজেই, পেশা নিয়ে কে কী বলল, সেটি নিয়ে তিনি ভাবেন না। তাই বিষয়টি সহজভাবেই নিয়েছেন।

কর্মক্ষেত্রে মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বলে জানান হিরা, অনেকে ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তিনি হরিজন সম্প্রদায়ের কি না। পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে মূলত হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের নিয়োগ হয়। এই পদে তার মতো যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অফিস সহায়ক পদে নেওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে তার চাকরি এখনো নিয়মিতকরণ হয়নি।

তবে এই বাধাকে বাধা মনে করেন না হিরা খাতুন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই পেশায়। তা ছাড়া কিছু শারীরিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। হাত নিচু করে ঝাড়ু দিতে পারেন না। এ ছাড়া আছে নানা প্রতিবন্ধকতাও। তার চাকরি আছে প্রায় ১০ বছর। বাকি সময়টা সম্মানজনকভাবে কাটিয়ে দিতে চান তিনি। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে চান। শ্রমে-ঘোমে সন্তানদের বড় করতে চান।

রাজশাহী কলেজে সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন হিরা খাতুনসহ মোট দুজন। এ ছাড়া মাস্টাররোলে এই পদে কাজ করেন আরও আটজন। আর্থিক সুযোগ-সুবিধায় সরকারি ও মাস্টাররোল কর্মীদের রয়েছে বিস্তর ফারাক। এই ব্যবধান থাকলেও প্রায় সবার যাপিত জীবনের উপাখ্যান অভিন্ন। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন যোদ্ধা। তাই তো টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরত।

এনএ