জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে প্রতিবন্ধিতা তাকে দমাতে পারেনি। মেধার জোরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের বৃত্তির টাকায় দুই বছর পড়ালেখা চালিয়ে যান। তবে করোনা মহামারিতে বন্ধ হয়ে যায় বৃত্তির টাকা। সেইসঙ্গে লেখাপড়াও। বলছিলাম কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সহশ্রাম গ্রামের নির্মাণশ্রমিক রফিকুল ও হুসনা আক্তার দম্পতির বড় ছেলেও মোকারম হোসেনের কথা। শুধু মোকারম নয়, তার ছোট দুই ভাইও জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। তিন সন্তান, পুত্রবধূ, নাতি নিয়ে বিপাকে পড়েছে পরিবারটি। 

সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সহশ্রাম গ্রামে জানা যায়, রফিকুল ইসলাম ও হুসনা আক্তার দম্পতির তিনটি ছেলে। তারা তিনজনই জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। বড় ছেলে মোকারম হোসেন (২৪), মেঝ ছেছে আবু রোজিন (২১) ও ছোট ছেলে মোহাম্মদ হাসান (২০)। মেঝ ছেলে আবু রোজিনকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়াছেন ও ছোট ছেলে মোহাম্মদ হাসানকে ১০ পাড়া কোরআনের হাফেজ বানিয়েছেন। অর্থের অভাবে আর তাদের পড়ালেখা হয়নি।

বড় ছেলে মোকারম হেসেনের জন্ম ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর। মোকারম ২০১৫ সালে পার্শ্ববর্তী নরসিংদী জেলার কারারচর মওলানা তোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জের নিকলীর সরকারি মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পসে করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসে ভর্তি হন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের বৃত্তির টাকায় তার পড়ালেখা চলছিল। তবে করোনা মহামারিতে বৃত্তির সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় মোকারমের লেখাপড়া।

মোকারম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কষ্ট করে হলেও সব কিছু ভালোভাবেই চলছিল। রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া ও অডিও করে পড়াশোনা করতে অনেক খরচ হয়। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে বৃত্তি হিসেবে যে টাকা পেতাম তাই দিয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা করতাম। অনেক সময় পরীক্ষার রাইটার পেতে কষ্ট হতো। সহপাঠীরা অডিও করে দিতো না। তাদেরকে খাওয়ালেই তারা পড়া অডিও করে দিতো। হঠাৎ করোনা মহামারি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় সেই ব্যাংকের বৃত্তির টাকা দেওয়া। তখন বন্ধ হয়ে যায় আমার পড়ালেখা। এখন যদি কেউ আমাকে সহযোগিতা করে তবে আমি অনার্সটা শেষ করতে পারতাম। 

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু হয়নি। প্রতিবারই প্রতিবন্ধিতা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বা বেসরকারি একটি চাকরি খুবই দরকার। কারণ পরিবারে এক সন্তান, স্ত্রী ও বাবা-মাসহ প্রতিবন্ধী দুই ছোট ভাই রয়েছে। সবার ভরণপোষণ বাবার একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এখন মাঝে-মধ্যে ট্রেনে হকারি করি। এভাবেই চলছে সংসার। তিন ভাই প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে যা সামান্য পাই তা দিয়ে সংসার চলে না।

মোকারমের ছোট ভাই মোহাম্মদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। পরে পরিবার থেকে আর খরচ চালাতে পারেনি। তাই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তিন ভাইই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। পরিবার নিয়ে যেন চলতে পারি সেজন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।

মোকারমের মা হুসনা আক্তার বলেন, জন্ম থেকেই তিন ছেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অভাবের সংসারে ছোট দুই ছেলেকে বেশি লেখাপড়া করাতে পারিনি। বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ও মেধাবী ছিল তাই বৃত্তি পেত। হঠাৎ করোনার কারণে সব শেষ হয়ে গেল। এখন তো আমরা জীবিত আছি, তাই ওদের জন্য কিছু করতে পারতেছি। আমরা যখন থাকব না, তখন তাদের কী হবে? 

সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাসেম আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোকারমরা তিন ভাই প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। সরকারিভাবে বা আমার পক্ষ থেকে সহায়তা করতে চেষ্টা করব। এছাড়া মোকারমের যোগ্যতা অনুযায়ী যেন চাকরি পায় সেই জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

কিশোরগঞ্জ সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই তিন ভাই ভাতা পাচ্ছেন। এখন তাদের পরিবার যদি সমাজসেবা থেকে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণ নিতে চায়, সেটার ব্যবস্থা করা যাবে।

এসপি