বিক্ষোভ মিছিল

কুড়িগ্রামের শিশু মাইশাকে অস্ত্রোপচারের নামে হত্যার অভিযোগে ঢাকাস্থ আলম মেমোরিয়াল হসপিটালের চিকিৎসক আহসান হাবীব ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী। শনিবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে কুড়িগ্রাম শহরতলির ভেলাকোপা গ্রাম থেকে প্রায় ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।

পরে তারা শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পৃথক পৃথকভাবে এসপি অফিস, ডিসি অফিস এবং সদর থানার সম্মুখে চিকিৎসক আহসান হাবীবের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করে।

মিছিল শেষে কুড়িগ্রাম অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন মৃত মাইশার স্বজনদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যপারে আশ্বস্ত করেন।

জানা যায়, মাত্র ৯ মাস বয়সে মাইশার ডান হাতের আঙুল চুলার আগুনে পুড়ে যায়। সে সময় রংপুরে চিকিৎসা করলেও হাতের তিনটি আঙুলের চামড়া কুকড়ে যায় শিশুটির। মেয়ের হাত ভালো হবে এমন আশা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডা. মো. আহসান হাবীব নামে এক চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হন মাইশার বাবা মোজাফফর। 

মাইশার হাত দেখে চিকিৎসক বলেন, অপারেশন করলে মাইশার হাত স্বাভাবিক হবে। সে অনুযায়ী গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকালে ঢাকার রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে হাতের অপারেশন হয় মাইশার। কিন্তু ঘণ্টা দেড়েক পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটির অবস্থা ভালো না। তাকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে রেফার্ড করে। সেখানে নেওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটি মারা গেছে।

ওই শিশুটির বাবা-মাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অস্ত্রোপচারের খরচ বাবদ নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দেয়। মরদেহ বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও ঠিক করে দেয়। বাড়ি ফিরে শিশু মাইশাকে দাফনের জন্য গোসল করানোর সময় নারীরা দেখতে পান, মাইশার নাভির নিচে পুরো পেট জুড়ে সেলাই করা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। স্বজনরা পুলিশে খবর দেন। কিন্তু ঢাকায় অপারেশন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলার পরামর্শ দেয় পুলিশ। পরে নিরুপায় স্বজনরা শিশু মাইশাকে বাড়ির আঙ্গিনার কাছে দাফন করেন। শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) ভুক্তভোগী মাইশার বাড়িতে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। 

৫ বছরের মাইশার পুরো নাম মারুফা জাহান মাইশা। সে কুড়িগ্রাম পৌরশহরের ৬ নং ওয়ার্ডের ভেলাকোপা ব্যাপারী পাড়া গ্রামের মোজাফফর আলী ও বেলি আক্তার দম্পতির মেয়ে। শিশুটির নানা ওসমান গণি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

শুক্রবার মাইশার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শোকের মাতম চলছে। মেয়ের এমন ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তার বাবা-মা, স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তারা মাইশার মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্তের দাবি জানান।

অপারেশনে মৃত্যু হয়েছে মেয়ের এই অভিযোগ জানিয়ে দিনমজুর বাবা মোজাফফর বলেন, ‘মেয়ের হাতের আঙুল ঠিক করার জন্য ঢাকার মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডা. আহসান হাবীবের কাছে যাই। তিনি সবকিছু দেখে বলেন বুধবার সকালে অস্ত্রোপচার করা হবে। রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল মেডিকেলে তার শেয়ার আছে জানিয়ে ডাক্তার বলেন, সেখানে অস্ত্রোপচার করালে খরচ কম লাগবে। 

বুধবার সেখানে হাতের অপারেশন করার সময় মেয়ে মারা যায়। পরে তারা আমাদের টাকা ফেরত দিয়ে ধমক দিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাড়ি এসে মেয়েকে গোসল করার সময় স্থানীয় মহিলারা দেখেন মেয়ের তল পেটের পুরো অংশ কেটে সেলাই করা।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এটা দেখে নিরুপায় হয়ে পড়ি। আমরা গরিব মানুষ। কিছু বুঝি নাই। হাত অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে তারা কেন আমার মেয়ের পেট কাটলো তা জানি না। আমাদেরকে কোনো কাগজপত্রও দেওয়া হয় নাই।’

মাইশার মরদেহের গোসল করানো স্থানীয় নারী মফিজা খাতুন বলেন, ‘মেয়ের হাতের আঙুল কাটা ছিল। পরে গোসলের সময় দেখতে পাই ওর নিচ পেটের পুরো অংশ কেটে সেলাই করা। পরে সকলকে জানাই।’

মেয়ে হারানোর শোকে কাতর মাইশার মা বেলি বলেন, ‘আমি কী ভুল করলাম! কেন মেয়েকে নিয়ে গেলাম। ওরা ডাক্তার না, কসাই। আমার মেয়ের পেট কাটলো কেন? ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলছে। আমি এর বিচার চাই। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই।’

ভুক্তভোগী পরিবারের দেওয়া ভিজিটিং কার্ড থেকে নাম্বার নিয়ে ডা. আহসান হাবীবের যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি অপারেশন করিনি। আমার শেয়ার থাকা আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে অস্ত্রোপচার অ্যারেঞ্জ করে দেই। সেখানে ঢাকা মেডিকেলের প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসক (সহকারী অধ্যাপক) ডা. শরিফুল ইসলাম অপারেশন করেন। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত শিশুটি মারা যায়।’

হাতের আঙ্গুল অপারেশন করার সময় পেট কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আহসান হাবীব বলেন, ‘এটা শিশুটির পরিবারকে জানিয়ে করা হয়েছে। হাতের আঙ্গুল অস্ত্রোপচার করে ওই স্থানে স্কিন সংযুক্ত করার জন্য পেট থেকে স্কিন নেওয়া হয়েছিল। পরিণত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে পায়ের থাই থেকে চামড়া নেওয়া হয়। কিন্তু শিশুটির থাই সরু থাকায় তার পেট থেকে চামড়া নিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল।’ 

তাহলে হাতের অপারেশন করতে গিয়ে মাইশার মৃত্যুর কারণ কী, এমন প্রশ্নে চিকিৎসক বলেন, আমি নিজেও অপারেশন থিয়েটারে প্রায় আধা ঘণ্টা ছিলাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। পরে আমি আমার বাসায় চলে যাই। 

পরে শিশুটির মৃত্যুর কারণ জানতে ডা. শরিফুল ইসলাম সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সম্ভবত অ্যানেস্থিসিয়ার কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। আসলে বেশিক্ষণ এনেস্থেটিক অবস্থায় থাকায় হয়তো সহ্য করতে পারেনি। এখানে অন্য আর কোনো কারণ নেই। তবে পুরো ঘটনায় আমি নিজেও মর্মাহত।’

 ডা. মো. আহসান হাবীব আরও বলেন, ‘রোগীটা আমার এলাকার। কুড়িগ্রামের যেকোনো লোক আসলে আমি হেল্প করি। এটা আসলে এ্যাকসিডেন্ট। তারপরও মেনে নেওয়া কঠিন। আমি নিজেও সেদিন স্তব্ধ হয়ে গেছি।’

নিজের পরিচয় সম্পর্কে ডা. মো. আহসান হাবীব জানান, তিনি বিসিএস ২৫ ব্যাচের চিকিৎসক। বর্তমানে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালীতে সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি) হিসেবে কর্মরত। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মিরপুরে তার চেম্বার। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতালের ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্য মতে ডা. মো. আহসান হাবীব ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অনকোলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। 

জুয়েল রানা/আরকে