সীমান্ত দিয়ে ভারতে সার পাচার, বিজিবির ওপর পাচারকারীদের হামলা

বিশ্ববাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধির খবরে লালমনিরহাটের অসাধু ডিলাররা দেশের বাজারে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে কয়েকদিন ধরে অভিযোগ করছেন কৃষকরা। এছাড়াও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতে সার পাচার করছে একটি চক্র।

এমনকি ভারতে সার পাচার করার সময় বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগও করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) সকালে বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের দীঘলটারী বিওপি'র সদস্যরা কুটিরচর এলাকায় অভিযান চালানোর সময় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় দুইটি বাইসাইকেল ও ৪ বস্তা সার সীমান্তের মেইন পিলার ৯২৫/৬ এর শূন্য রেখায় ফেলে পালিয়ে যায় চোরাকারবারীরা।

জানা গেছে, কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে কৃষি উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার। তাই কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল পণ্য ও সরঞ্জামে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। কৃষি উৎপাদনে সারের প্রয়োজন অনেক। চলতি রবি মৌসুমে সবজি উৎপাদনে সারের চাহিদা বেশি। এছাড়াও আসন্ন বোরো ধান উৎপাদনেও সারের ব্যাপক প্রয়োজন। এ কারণে সরকার সার সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। অপর দিকে সার সরবরাহ ও বিপননে মনিটরিং কমিটিও গঠন করেছে।

কিন্তু দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সার বিপনন ও সরবরাহ মনিটরিং কমিটিকে ম্যানেজ করে কৌশলে অবৈধ মজুদ করে গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। ফলে চলতি রবি মৌসুমেই সার সরকারি মূল্যের তুলনায় অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ কৃষকদের। সরকারি ডিলাররা রশিদ মূল্যে বিক্রির কথা থাকলেও কৃষকদের কোনো রশিদ দেওয়া হচ্ছে না। কখনও রশিদে সরকারি মূল্য লিখলেও মূলত অতিরিক্ত দাম ছাড়া সার মিলছে না।

কৃষকদের এমন অভিযোগে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও সারের বাজার স্থিতিশীল করতে পারছে না জেলা প্রশাসন। ফলে সরকারি মূল্যের চেয়েও অতিরিক্ত দামে সার ক্রয় করে রবি মৌসুমে সবজি চাষাবাদ করছেন কৃষকরা। এছাড়াও আসন্ন বোরো ধান চাষাবাদে সারের সহজলভ্যতা নিয়েও চিন্তিত কৃষকরা।

এদিকে অবৈধ মজুদকৃত সার ভারতে পাচার হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা জেলা লালমনিরহাটের প্রায় ২২ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে কাঁটাতারের বেড়াহীন। এ অংশে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় খুব সহজে ভারতে পাচার হচ্ছে সারসহ নানান পণ্য। চোরাকারবারীরা সার পাঠিয়ে ভারত থেকে গরু আর মাদকসহ নানান পণ্য পাচার করছেন।

সীমান্তবাসী জানান, কৃষকের লেবাস নিয়ে পাচারকারীরা দিনের আলোতেও সার পাচার করছে। রাতের আঁধারে নিয়ে আসে গরু আর মাদক। তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের দারুণ সখ্যতা রয়েছে। সার পাচার ঠেকাতে বডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা অভিযান চালালে পাচারকারীরা নিজেদের কৃষক দাবি করে সংঘবদ্ধ হয়ে বিজিবি'র ওপর আক্রমণ করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাঠ পর্যয়ের কৃষি কর্মকর্তা ও সরকারি দলের নেতাদের মদদে সার পাচার হচ্ছে বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ।

জেলার আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের মাঝপাড়া গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে দুর্গাপুর বাজারের খুচরা সার বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম সার পাচারের বেশ সক্রিয়। গত দুই সপ্তাহে তারা দুই ভাই প্রায় এক হাজার বস্তা ড্যাপ সার ভারতে পাচার করেছেন বলে স্থানীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সিরাজুল ও শরিফুল ছাড়াও ওই সীমান্তে অনেকেই ভারতে সার পাচার করছেন বলে স্থানীয়দের দাবি। কৃষকরা সার না পেলেও পাচারকারীরা ঠিকই সার পাচ্ছেন বলে ক্ষোভ চাষিদের।

ভারতে সার পাচার হচ্ছে এমন একটি গোপন সূত্রে বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) সকালে বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের দীঘলটারী বিওপি'র সদস্যরা কুটিরচর এলাকায় অভিযান চালায়। 

এ সময় দুটি বাইসাইকেলযোগে ৪ বস্তা সার নিয়ে ওই সীমান্তের মেইন পিলার ৯২৫/৬ এর শূন্য রেখার ১০০ গজ দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছলে সিরাজুল ও শরিফুলকে ধাওয়া দেয় বিজিবি। এ সময় সারের সাইকেল ফেলে পালিয়ে যায় বলে মামলায় দাবি করে বিজিবি।

জব্দকৃত এসব সার ও সাইকেল নিয়ে বিওপি ক্যাম্পের ফেরার পথে পাচারকারী সিরাজুল ও শরিফুল দলবল নিয়ে বিজিবি'র ওপর আক্রমণ চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য গিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে। পাচারকারীদের হামলায় দুইজন বিজিবি সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পরদিন শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) বিজিবি'র দীঘলটারী বিওপি'র নায়েক সাবদাদুল হক বাদী হয়ে সার পাচারকারী সিরাজুল ও শরিফুলসহ অজ্ঞাত ১৫/২০ জনের বিরুদ্ধে আদিতমারী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদিতমারী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান বলেন, সার পাচারের সত্যতা মিলেছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাত রয়েছে।

জেলা সার বীজ সরবরাহ ও বিপনন মনিটরিং কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় সারের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের ঠেকাতে বিক্রয় পয়েন্টে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কাঁটাতারের বেড়াহীন সীমান্তবর্তী জেলা হিসেবে সার ভারতে পাচার হচ্ছে এমন একটি তথ্যের ভিত্তিতে মনিটরিং কমিটি ও বিজিবিকে সজাগ করা হয়েছে। পাচাররোধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

নিয়াজ আহমেদ সিপন/এমএএস