স্বপ্ন ছিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর সপ্তম সেমিস্টার পরীক্ষার সময় আর্থিক সংকটের কারণে আর পড়াশোনা করতে পারেননি। ২০০৭ সালে কাজের সন্ধানে মালদ্বীপ যান। কিন্তু সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসেন দেশে। এরপর ২০১১ সালে ৬ লাখ টাকায় যেতে চেয়েছিলেন ইউরোপে। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য সহায় হয়নি। দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার হন।

উন্নত দেশের কথা বলে দালালরা তাকে নিয়ে যান ভারতে। প্রায় ৫ মাস ভারতের চেন্নাইয়ে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। এরপর বিভিন্ন মুরগির খামারে কাজ করে খামারিদের কাছ থেকে মুরগি পালনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।খামারে কাজ করার প্রাপ্তি হিসেবে উপহার পান চার জোড়া বিদেশি জাতের মুরগি। ২০১৬ সালে দেশে এসে গ্রামের বাড়িতে এই চার জোড়া মুরগি দিয়েই খামার শুরু করেন তিনি। এখন তার খামারে ৪০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি দুই শতাধিক মুরগি।

তিনি হলেন রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাদেশ হাট গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৭)। তিনি ওই গ্রামের মৃত আমীর হোসেনের ছেলে।

জানা গেছে, ভারত থেকে চার জোড়া মুরগি এনে জাহাঙ্গীর ছোট পরিসরে একটি খামার শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চার জোড়া থেকে এখন তার সংগ্রহে রয়েছে দেশি-বিদেশি ৪২ প্রজাতির প্রায় দুই শতাধিক মুরগি। এসব মুরগির মধ্যে রয়েছে সিল্কি, সেব্রাইট গোল্ডেন, সিলভার সেব্রাইট, বাফ সেব্রাইট, পলিস ক্যাপ, ক্রেস্টেড পলিস ক্যাপ, উইন্ডোট, মিলি, বেলজিয়াম বিয়ার্ড, ব্রাহামা, কলম্বিয়ান ব্রাহমা, ল্যাভেন্ডার ব্রাহমা, এরা কনা, বার্বি ডিনার, অনাকাদুরি, কসমো, সেরমা, ফনিক্স, ইয়োকোহামা, সুমাত্রা, সুলতান, আইয়ামচিমনি, লেকেল ভেন্ডার, ব্লু-কোচিন, মলটেট কোশ্চেন, ব্লু-ফিজেল, পেন্সিল লেগ, গেম বেন্থাম, জায়ান্ট কোচিন, ব্লু-বারলেচ, সিলভার লেস, জাপানিজ বেন্থাম, চাবু, প্যারট লিপ, আঁচিল, স্প্যানিশ হোয়াইট ফেস, ডংতাও, জঙ্গল ফাউ, আমেরিকান ব্রাহমা, রেড বারবন এবং সুলতান জাতের মুরগি। এসব মুরগি ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়।

এসব মুরগির ডিম থেকে নিজেই হ্যাচিং করে বাচ্চা উৎপাদন করছেন জাহাঙ্গীর। আর এক দিনের বাচ্চাও বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকা জোড়া। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের শৌখিন ক্রেতারা তার খামার থেকে এসব মুরগি কিনে নিচ্ছেন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলাসহ স্থানীয় দর্শনার্থীরা এসে তার খামারে ভিড় করছেন।

জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, স্বপ্ন ছিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারিনি। এরপর বিদেশে যাওয়ার জন্য কয়েক দফায় প্রতারণা শিকার হই। তারপর ভরত গিয়ে চেন্নাইয়ে একটি মুরগির খামারে চাকরি করি। সেখান থেকে মুরগি পালনের উৎসাহ পাই। তারপর সেখান থেকে চার জোড়া বিদেশি মুরগি এনে দেশে ছোট পরিসরে খামার শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার পশু-পাখির প্রতি ভালো লাগা কাজ করতো। ২০০৭ সালে আমি মুরগি পালনের ওপর যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। আমার মুরগি পালনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভারত থেকে আনা ৪ জোড়া মুরগি থেকে খামার শুরু করি। এখন আমার খামারে প্রায় ৪২ প্রজাতির দেশি-বিদেশি দুই শতাধিক মুরগি রয়েছে। এসব মুরগি আমি নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছি। যেগুলো ১৫-২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা জোড়াও বিক্রি হচ্ছে। খরচ বাদ দিয়ে মুরগি, ডিম ও বাচ্চা বিক্রি করে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

জাহাঙ্গীর বলেন, আজকের অবস্থানে আসতে আমার ৫ বছর সময় লেগেছে। আমার একটি অনলাইন পেজ রয়েছে যার নাম ‘ইত্যাদি এগ্রো এন্ড হ্যাচারী’। অনলাইনের মাধ্যমে এখন আমার মুরগি বিক্রি হচ্ছে। আমার টার্গেট ১০০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি মুরগি সংগ্রহ করা। সরকারি সহায়তা পেলে বিশ্বের সর্বাধিক মুরগির জাতের সংগ্রাহক হিসেবে গিনেস বুকে নাম লেখানোর। 

দর্শনার্থী শুভ বিশ্বাস, সাকিব শেখ, ইখলাসুর রহমানসহ কয়েকজন বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে আমরা মুরগির খামার দেখতে এসেছি। এখানে এসে বিভিন্ন জাতের বিদেশি মুরগি দেখে ভালো লাগছে।

রাজবাড়ী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল হক সরদার বলেন, বিদেশি মুরগি অনেকেই পালন করে। কিন্তু জাহাঙ্গীরের খামারে যে মুরগি রয়েছে তা ব্যতিক্রম। মূলত তিনি শখের বসে মুরগিগুলো পালন করছেন। তিনি নিজেই মুরগির ডিম হ্যাচিং করে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করেন। এতে তার বেকারত্ব দূর হয়েছে। এখন তিনি বাণিজ্যিকভাবে খামারে মুরগি পালন করছেন। যদিও এই মুরগিগুলো মাংসের জন্য নয়, শখের বসে লালন-পালন করা হয়। তবে দিন দিন এর প্রসার বাড়ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে এসে অনেকেই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে মুরগি নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা জাহাঙ্গীরের খামার পরিদর্শন করেছি। তার খামারে ২০ হাজার টাকা জোড়া থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা জোড়া মূল্যের মুরগি রয়েছে। আমরা তার খামার রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছি। এছাড়া তার খামারে যাবতীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করছি।

এসপি