করোনার প্রভাব কাটতে না কাটতেই  সিরাজগঞ্জে নতুন করে এইডসের ঝুঁকি বাড়ছে। চলতি বছর ৭৬ জন পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত ৬ মাসে সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষায় ৬৩ জন পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। উদ্বেগজনক হারে এ জেলায় বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ রোগী। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৪ জন পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের এইচটিসি/এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মাসুদ রানা জানান, ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সিরাজগঞ্জে এইচআইভি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখানে ৭৬ জন পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে।

তিনি জানান, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর পজিটিভ রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। পজিটিভ রোগীর বেশির ভাগই ইনজেকটিভ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। এরা ড্রাগ গ্রহণের সময় সুই এবং সিরিঞ্জ শেয়ার করে, এ জন্যই পজিটিভের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

মাসুদ রানা বলেন, এখনই সচেতনতা তৈরি এবং বেশিরভাগ মানুষকে যদি এইচআইভি পরীক্ষার আওতায় না আনা যায়, তাহলে সিরাজগঞ্জে এইডস মহামারি আকার ধারণ করবে। এখানে পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম। তার মধ্যে যাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে তাদের ৫০ ভাগই পজিটিভ হচ্ছে। বর্তমানে জেলায় এখন পর্যন্ত ৬৭ জন এইচআইভি পজিটিভ রোগী রয়েছে। তার মধ্যে দুইজনের বাড়ি বেলকুচি, বাকি ৬৫ জনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। এই পরীক্ষাগারে অন্য শনাক্ত রোগীরা জেলার বাইরের। এর মধ্যে মাদকাসক্ত ব্যক্তি, যৌনকর্মী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং সাধারণ মানুষ রয়েছে। যারা আক্রান্ত তাদের মোটিভেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করা হচ্ছে। যেহেতু এই রোগের কোনো ভ্যাকসিন বের হয়নি, তাই তাদের সাধারণ ওষুধ এবং বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে এআরটি সেন্টারে পাঠাচ্ছি। সেখানে তাদের থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে হচ্ছে।

তিনি জানান, মানুষের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস থাকলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যেহেতু এইডস একবার হলে আর সারে না, তাই তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটা বাড়ানোর জন্য থেরাপি দিতে হবে। এক সময় সিরাজগঞ্জে কোনো মাঠ কর্মী ছিলো না তাই এইচআইভি পরীক্ষা তেমনভাবে হয়নি। এখন মাঠকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, ফলে তারা মানুষকে কাউন্সিলিং করে পরীক্ষার আওতায় আনছে। এজন্যই এত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সকল ধরনের মানুষকে এই পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্বৃদ্ধ করতে হবে যাতে সকলেই এই পরীক্ষার আওতায় আসে। গর্ভবতী মা, রক্ত প্রদানকারী, ইনজেকটিভ অ্যাডিক্টেড, যৌনকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে এই পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। সিরাজগঞ্জে পজিটিভের সংখ্যা যেহেতু বাড়ছে এবং অনেকে রয়েছে, তাই এখন বেশি বেশি প্রচার এবং সচেতনা বৃদ্ধি না করলে জেলাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।   

সিরাজগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবু আব্দুল্লাহ জাহিদ বলেন, জেলায় মূলত ইনজেকটিভ ড্রাগ অ্যাডিক্টেডের মাধ্যমে এইচআইভি বেশি ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে সবাই আতঙ্কিত। জেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সবার ধারণা প্যাথিডিনের মাধ্যমে এই ড্রাগ গ্রহণ করছে। কিন্ত আসলে প্যাথিডিন লাইসেন্স ধারীরা বিক্রি করে। খুচরা পর্যায়ে এটা প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয় না। এটা সাধারণত হাসপাতালগুলোতে বিক্রি হয় অপারেশনের কাজে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু ভারতীয় নিষিদ্ধ ব্যুপ্রিনরফিন ইনজেকশন চোরাই পথে এদেশে আসছে এবং এরই মাধ্যমে ড্রাগ অ্যাডিক্টেডরা ইনজেকশন নিচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে দুই হাজারের বেশি ব্রপ্রিনরফিন আটক করা হয়েছে। কিন্তু শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে শহরের ধানবান্ধি মহল্লায় এই ইনজেকশন বিক্রি করা হচ্ছে। সুচ-সিরিঞ্জ শেয়ারের কারণে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষকে সচেতন করা না হলে এটি ভয়াবহ রূপ নিবে।

এইচআইভি প্রতিরোধের বিষয়ে সিরাজগঞ্জে কাজ করে লাইট হাউস নামে একটি এনজিও। লাইট হাউসের সাব ডিআইসি ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম জানান, জেলায় একমাত্র তারাই এইচআইভি প্রতিরোধ নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ করেন। তারা মূলত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতেনতার কাজ করেন। এছাড়াও পুরুষ যৌন কর্মীদের মধ্যেও তারা সচেতনতার কাজ করেন।

তিনি জানান, দুই বছর ধরে সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ইনজেকটিভ ড্রাগ অ্যাডিক্টেড এবং নারী যৌন কর্মীদের মধ্যে কাজ করছেন। তাদেরকে পরীক্ষার আওতায় আনছেন। তাতে যা বুঝা যাচ্ছে, সিরাজগঞ্জ এইডস ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। সবাইকে এখনো পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। 

সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন রামপদ রায় বলেন, জেলায় দ্রুত বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ রোগীর সংখ্যা। আমরা সরকারিভাবে সবাইকে সচেতন করতে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। এইচআইভি রোগ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সকলকে পরীক্ষার আওতায় আনার চেষ্টা করছি।

শুভ কুমার ঘোষ/আরএআর