মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় ভাসমান পদ্ধতিতে ফসল চাষ করে সফল হয়েছেন অনেক কৃষক। মাটির পরিবর্তে পানির ওপর ভাসমান শাকসবজি চাষ বেশ সাড়া ফেলেছে কৃষকদের মাঝে। বিশেষ করে ভূমিহীন কৃষকেরা এতে বেশ সুফল পাচ্ছেন।

কালকিনি উপজেলার রমজানপুর, সিডিখান , মিয়ারহাট এলাকায় এ ধরনের ভাসমান সবজি আবাদ করা হচ্ছে। ফলনও বেশ ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষকেরা।

কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের সহায়তায় প্রদর্শনী প্রকল্পের আওতায় কৃষক পর্যায়ে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যেসব অঞ্চল পানির নিচে থাকে, সেখানে কৃষকদের ভাসমান সবজি চাষের জন্য আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য মূলত কচুরিপানা দিয়ে শয্যা (বেড) তৈরি করা হয়। প্রতিটি শয্যা ২০ মিটার লম্বা, প্রায় দেড় মিটার পুরু ও প্রস্থ চার মিটার। তিনটি বেড মিলে একটি প্রকল্প। উপজেলায় এমন মোট ২০টি প্রকল্পে শাকসবজির আবাদ চলছে। কৃষকেরা প্রধানত লালশাক, কলমি লতা, লতিরাজ কচু ও লাউয়ের চাষ করছেন। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। কৃষি কর্মকর্তারা চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করছেনচ। কালকিনি উপজেলার রমজানপুর, সিডিখান , মিয়ারহাট এলাকায় এ ধরনের ভাসমান সবজি আবাদ করা হচ্ছে। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে।

বিশেষ করে ভূমিহীন মানুষেরা এতে বেশ সুফল পাচ্ছেন। রমজাপুর ইউনিয়নের বাবু রাম বিশ্বাস বলেন, এভাবে পানির ওপর কচুরিপানার বেডে শাকসবজির চাষ করা সম্ভব আগে কখনো তারা চিন্তাই করেননি। কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ ও সহায়তা দিয়েছেন। এখন অনেক ভূমিহীন কৃষক শাকসবজি বিক্রি করে তারা অর্থ উপার্জন করছেন।

কালকিনির দক্ষিণ রমজানপুরের চরপালরদী গ্রামের জুলহাস মোল্লা ও কৃষক ছাওসার মিয়া বলেন, স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগিতায় ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করেছি। আমি ও আমার স্ত্রী-সন্তানেরা মিলে ভাসমান বেডে পরিচর্যা করে ২৩০ টি লাউ বিক্রি করেছি। প্রতিটি লাউ ৪০-৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়াও মাচার নিচে লালশাক, লাউশাক, নাগা শশার ভালো ফলন হয়েছে।

ওই গ্রামের কৃষক রোহেল মিয়া জানান, ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে এ পর্যন্ত ৮০ কেজি খিরা, ৭০টি মিষ্টি কুমড়া ও নানা রকম শাক উৎপাদন করে বিক্রি করে লাভবান হয়েছি।

স্থানীয় যুবক আবদুর রহমান বলেন, আমাদের বাড়ির পাশের শাহিন বিষমুক্ত ভাসমান সবজি চাষ করে সফল হয়েছে। তার সবজি খুব সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। আমারা এখান থেকেই সবজি নিয়ে খাই। আমিও কৃষি অফিসের সহযোগিতা নিয়ে তার মত এ পদ্ধতিতে আমাদের জমিতে সবজি চাষ করব।

উপজেলার  মোস্তাফিজুর রহমান ও হাকিম মোল্লা বলেন, আমরা এরই মধ্যে ১৫ হাজার টাকার লালশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, গিমা কলমি, শিম ও লাউ বিক্রি করেছি। নতুন আরও সবজি হচ্ছে।

উপজেলার চরফতে গ্রামের কৃষক শাহিন বলেন, ‘ভাসমান সবজি চাষের ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু এ বছর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘ পাচ বছর ধরে ভাসমান সবজি চাষ করে চলছি। আমার ৮টি বেড তৈরি করতে চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আমি এরই মধ্যে ১৩-১৫ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি। এখনো অনেক সবজি বেড রয়েছে।’

রমজানপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রমজানপুর এলাকার কৃষক রেজাউল কাজী বলেন, ‘গত বছরে প্রদর্শনী প্রকল্পের আওতায় সরকারি খরচে ভাসমান সবজি চাষ করি। তখন একটা ধারণা হয়। এ ধরনের চাষ লাভজনক। তাই আমি এবার নিজে ৬টি বেডে লাউ চাষ করেছি। খুব ভালো লাউ হয়েছে। যেসব ময়লা পুকুর, ডোবা ও খাল এমনিতেই পড়ে থাকে, সেসব জায়গায় আমরা ভাসমান সবজির চাষ করতে পারছি।’

উপজেলা কৃষি উপ-সহকারি অফিসার তানভীর হাসান বলেন, যেসব এলাকা বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে থাকে, সেসব এলাকায় ভাসমান সবজি চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হতে পারেন। তবে এ ধরনের উদ্যোগ কৃষকদের মাঝে আগে ছিল না। এই প্রদর্শনী প্রকল্প দেখে এখন অনেক কৃষক উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে সবজি চাষ কম খরচে অধিক লাভজনক হওয়ায় শাহিনকে দেখে এলাকার ৩০-৪০টি পরিবার এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদের সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া হয় নিয়মিত। কমপক্ষে পাঁচটি বেড থাকলে প্রত্যেক কৃষককে তাদের পক্ষে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উপজেলায় দুই বছর ধরে এ ধরনের প্রদর্শনী প্রকল্প চলছে। ইতোমধ্যে কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে।

রাকিব হাসান/আরকে