বেড়েছে ইটের উৎপাদন খরচ, খেসারত দিচ্ছেন ক্রেতারা
ইটভাটা
নীলফামারীতে কয়লা আমদানি সংকট ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ইট উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ইটভাটা মালিকরা। এলসি (ঋণপত্র) জটিলতায় আমদানি না হওয়ায় বেড়েছে কয়লার দাম। এদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ায় এর খেসারত দিচ্ছেন ক্রেতারা। ইটের প্রকারভেদ অনুযায়ী দাম বেড়েছে প্রতি হাজারে ১৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, নীলফামারীতে ভাটা আছে প্রায় ৬৪টি। যার সবকটির ইট উৎপাদন নির্ভর করে কয়লার ওপর। ইট পোড়ানোর মৌসুম অনেক আগে শুরু হলেও কয়লা সংকটে এখনো বেশিরভাগ ভাটায় জ্বলেনি আগুন। একদিকে কয়লার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। বিভিন্ন বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলেও এবার ধরাশায়ী হতে হয়েছে অনেক ভাটা মালিককে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও প্রতিটি ভাটায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ২ শতাধিক শ্রমিক। ৬৪টি ভাটায় এবার কাজ করার কথা ১২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। তবে কয়লা সংকট ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিটি ভাটায় কাজ করছে মাত্র ১০০ থেকে ১২০ জন শ্রমিক।
ভাটা মালিকরা জানান, জ্বালানী সংকট চলছে। আড়াইগুণ উচ্চমূল্য দিয়েও কয়লা মিলছে না। প্রতিবছর ভারত থেকে কম দরে কয়লা এনে ইট পোড়ানো হতো। চলতি মৌসুমে সবকিছু কঠিন হয়ে গেছে। ভারত পর্যাপ্ত কয়লা সরবরাহ করছে না এবার। এতে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে। যা গতবারের তুলনায় আড়াইগুণ বেশি। গতবছর একটন কয়লা কিনতে হতো ৯ হাজার টাকায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা আমদানিতে সংকটের সৃষ্টি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে প্রতি টন কয়লার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা। এর কারণ ভারত থেকে কয়লা আমদানি প্রক্রিয়া ও কয়লা সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। পার্বতীপুর কয়লাখনি থেকে ইটভাটা প্রতি ১০০ টন করে কয়লা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। প্রতিটি ভাটায় ৫০০ থেকে ৭০০ টন কয়লা দরকার প্রতি মৌসুমে।
বিজ্ঞাপন
গত মৌসুমে উন্নতমানের ইট প্রতি হাজার বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ থেকে ৯ হাজার টাকায়। বর্তমান মৌসুমে একই পরিমাণ ইট বিক্রি হচ্ছে ১২ হাজার টাকায়। একই পরিমাণ দ্বিতীয় সারির ইটের দাম ৭ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫০০ টাকায়। নিম্নমানের ইটের (তিন নম্বর) দামও বেড়ে গেছে। এই ইট গতবার ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার দাম বেড়ে একই পরিমাণ ইটের দাম হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ টাকা।
জলঢাকা খুটামারা এম এইচ ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী মাহমুদার হোসেন বলেন, নানা বিধিনিষেধ, ঝামেলা মোকাবেলা করে আমরা ভাটা চালাচ্ছি। এদিকে টাকা দেওয়ার অনেকদিন পর এ বছর কয়লা পেয়েছি। আগে এক টন কয়লা কিনতাম ৯ হাজার টাকায় তা এখন ২০ হাজার টাকার ওপরে। এদিকে মজুরি না বাড়ালে শ্রমিক পাওয়া যায় না। সব মিলে উৎপাদন খরচ বাড়ায় বেড়ে গেছে ইটের দাম। আর চাহিদার তুলনায় কয়লা পাচ্ছি না আমরা। জানি না ভবিষ্যৎ কী হবে।
দুহুলী এন বি এল ভাটার স্বত্বাধিকারী আব্দুল হাই বলেন, কয়লা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বলছে ডলার সংকটের কারণে তারা কয়লা আমদানি করতে পারছে না। এছাড়া এদিকে পরিবহন খরচও বেড়েছে। গত মৌসুম থেকে এবার কয়লার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এমন অবস্থায় নতুন ইটের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায়ও দেখছি না আমরা, আমাদেরও তো চলতে হবে। দামের প্রভাব ক্রেতাদের ওপর একটু তো পড়বেই। একই সঙ্গে উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাঘাত ঘটবে। সরকারের কাছে অনুরোধ দ্রুত যেন এ কয়লা সংকট দূর করেন।
কয়লা ব্যবসায়ী মেসার্স নুর ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বলেন, আসলে আমদানিকারকরা বলছে যে এলসি না হওয়ায় কয়লা আনা সম্ভব না। দাম বাড়ার মূল কারণ আসলে ওটাই। এখানে আমাদের কিছু করার নাই। আমরা শুধু সাপ্লাইয়ার। এটার ভুক্তভোগী আমরাও।
এদিকে বাড়ি নির্মাণের অর্ধেক কাজ শেষ করে দাম বৃদ্ধির কারণে বাকি অংশ শেষ করতে পারছেন না নীলফামারী শহরের নীল প্রতিভাপাড়ার বাসিন্দা বুলবুল আহম্মেদ। তিনি বলেন, কয়েকমাস আগে বাড়ির কাজের জন্য ইট কিনেছিলাম তখন দাম অনেক কম ছিল। এখন ইট কিনতে গিয়ে শুনি দাম বেশি। ৮ হাজারের ইট এখন ১২ হাজার টাকা। বাড়ির কাজ যখন শুরু করি তখন ভেবেছিলাম যে আস্তে আস্তে কাজ শেষ করব। কে জানত ইটের দাম এত বাড়বে। এদিকে সিমেন্টের দাম বেশি। সব কিছুর দাম বাড়লে আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায়? এখন বাকি কাজ শেষ করতে পারব কিনা জানি না।
স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবা খাতুন বলেন, সবার মতো আমারও স্বপ্ন পাকা বাড়িতে থাকার। বাড়ির কাজে হাত দিতে চাচ্ছি কিন্ত দিন দিন সব কিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে কীভাবে করব।
নীলফামারী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান সেলিম বলেন, আসলে এ অবস্থায় আমরা বিপাকে পড়েছি। মাটিকাটা শ্রমিকসহ সব ধরনের খরচ বাড়ছে। কয়লা আগে ৯ হাজার থেকে ২২ হাজার পর্যন্ত কিনেছি এখন ৩১ হাজার টাকা। এখন সমস্যা এলসি না সিন্ডিকেট এটা আমরা বলতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, অচিরেই সরকার যদি কয়লার উচ্চমূল্য ও সংকটের বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা না নেয় তাহলে এ বছর ইট উৎপাদন ব্যাহত হবে। এমন চলতে থাকলে সিংহভাগ ভাটা বন্ধ হয়েও যেতে পারে।
শরিফুল ইসলাম/আরকে