পাবনার সুজানগর উপজেলার প্রয়াত রাধাগোবিন্দ চৌধুরী (দুলাল মাস্টার) একজন বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন। যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন কিংবা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তারাই জানেন- কী বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। 

একদিকে তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন ও বিচক্ষণ সংগঠক। অপরদিকে ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। সর্বোপরি একজন সফল বাবা। তার আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে জয়ন্ত কুমার চৌধুরী ভারতের শিলিগুড়িতে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় অবসর নিয়েছেন। মেজো ছেলে অচিন্ত চৌধুরী ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। আর ছোট ছেলে নামকরা অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।

শিক্ষক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে ছিল  রাধাগোবিন্দ চৌধুরীর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও নিত্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে তার তথ্য ভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। যে কোনো প্রয়োজনে এলাকাবাসী তার শরণাপন্ন হতেন। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকল কাজে সহযোগিতা করতেন। শুধু তাই নয়, আচার-আচরণ, চলাফেরা, আদব-কায়দা, ভদ্রতা, বুদ্ধিমত্তা সকল বিষয়েই তার ছিল অনুকরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব।

রাধাগোবিন্দ চৌধুরী  ১৯৩১ সালে পাবনা শহর থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরে সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের কামারহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ক্ষিতিশ চন্দ্র সাহা। তিনি ১৯৫৩ সালে ঐতিহ্যবাহী বেড়া সরকারি বিপিন বিহারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। এর এক বছর পর ১৯৫৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নেওয়ার আগে একইসঙ্গে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পদে চাকরি করতেন। ‘এক ব্যক্তির এক চাকরি’ নিয়ম চালু হওয়ার পরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। 

এরপর উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে চাকরি করেন রাধাগোবিন্দ চৌধুরী। পরে ১৯৭৩ সালে কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখে চাকরি থেকে অবসরে যান। অবসর নেওয়ার পর পার্শ্ববর্তী সৈয়দ আলী খান কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠা করে প্রায় আট বছরের মতো সেখানে শিক্ষকতা করেন।

ছোট ছেলে অভিনেতা চঞ্চল চেীধুরীর প্রতি সব সময় একটু বেশিই আবেগী ছিলেন রাধাগোবিন্দ চৌধুরী। এক সময় তাদের গ্রামে পত্রিকা যেত না। যখন নাজিরগঞ্জ বাজারে পত্রিকা যাওয়া শুরু হলো, তখন চঞ্চল চৌধুরী তার বাবার কাছে পত্রিকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। তার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবা গভীর মনোযোগে পুরো পত্রিকা পড়তেন। আর ছেলের খবর প্রকাশিত হলে, সেই অংশটুকু কেটে বাড়িতে নিয়ে যেতেন। সেগুলো স্কচটেপ দিয়ে বাড়ির দেয়ালে লাগিয়ে রাখতেন। দেয়ালে পত্রিকার কাটিং লাগানো থাকলেও সেই রাধাগোবিন্দ চৌধুরী আর নেই। 

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে তার বাড়িতে গেলে বেশ কয়েকজন ছাত্র ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। 

রাধাগোবিন্দ চৌধুরীর ছাত্র ও বর্তমান কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রাহমান বলেন, শিক্ষক হিসেবে স্যার ব্যবহার খুবই অমায়িক ছিলেন। সে সময় আমাদের স্কুল ছিল পদ্মা নদীর পাশে একটি ছোট্ট টিনের চালার। সামান্য বৃষ্টি হলেই সবাই ভিজে একাকার হয়ে যেতাম। বিদ্যালয়ের মাঠের গাছের নিচে বসিয়ে স্যার নিজেই ক্লাস নিতেন। একদম বাড়ির আঙিনায় স্কুলটি। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী না আসলেও তিনি সবার আগে এসে বসে থাকতেন। আবার সবার পরে স্কুল থেকে বাড়ি যেতেন। যেদিন স্কুলে কোনো শিক্ষক আসতেন না সেদিন স্যার নিজেই একে একে সব ক্লাস নিতেন। স্যারের কথা আমি ভুলতে পারব না। 

তিনি আরও বলেন, স্যারের বাড়ির পাশেই স্কুলটি হওয়ায় পাবনা থেকে ডিসি-এসপি-ইউএনও বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা পরিদর্শনে আসলে চঞ্চল চেীধুরীর বাবাকে ডাকতে বলতেন। তিনি স্কুলে আসলে সম্মানার্থে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসার অনুরোধ জানালেও তিনি বলতেন এ চেয়ার আগে আমার ছিল, এখন তোমার। সুতরাং আমি বসতে পারব না। স্যার যতক্ষণ থাকতেন আমি আমার চেয়ারে বসিনি। তার মতো গুণী মানুষ কালেভদ্রে জন্মে। আমার সৌভাগ্য ছাত্র হিসেবে তার সান্নিধ্য পেয়েছি।

আরেক ছাত্র খোন্দকার হুমায়ুন কবির বলেন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছাড়াও স্যারের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। স্যার আর আমার বাবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্যার দীর্ঘদিন কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার বাবা ছিলেন ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেকেই আমার ভাইবোনদের সহপাঠী। এজন্য পারিবারিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্যারের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া ছিল আমাদের রুটিন কাজ।

তিনি আরও বলেন ছোটবেলায় স্যারকে খুব ভয় পেতাম। স্যার যদি কোথাও থাকতেন তাহলে আমরা সেখান দিয়ে যেতাম না। অন্য পথ দিয়ে ঘুরে যেতাম। অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। শেষ বয়সে তো স্যার নিজেই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতেন। ভেতরে ভেতরে সংকোচ লাগলেও মনে মনে গর্ব অনুভব করতাম। মনের মধ্যে আজকে অনেকটা শূন্যতা অনুভব করছি এই ভেবে যে - গ্রামে গেলে শতবর্ষী স্যারের সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমাদের পুকুরে স্যার আর কোনো দিন গোসল করতে আসবেন না। স্যারের পবিত্র আত্মা পরপারে শান্তিতে থাকবে। ওপারে বসে যদি তিনি দেখেন তার আলোয় আমরা আলোকিত হয়েছি, তাহলেই তিনি খুশি হবেন।

আব্দুল আজিজ মন্ডল নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, নদী পারে স্কুল হওয়ায় স্কুলে আসতে ভয় পাব বলে স্যার আমাকে নিজে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল ছুটি হলে আবার বাড়িতে রেখে আসতেন। ভালোবাসা মায়া-মমতা দিয়ে আমাদের পাঠদান করিয়েছেন। ক্লাসে খুব ভালো করে বুঝাতেন। স্যার সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। তবে বাংলা আর গণিতে বেশি দক্ষ ছিলেন। এমনভাবে অংক বুঝাতেন যে খুব সহজেই আমরা বুঝে যেতাম। স্যার কর্মজীবনে যেমন ছিলেন তার চেয়ে সামাজিক জীবনে আরও বেশি মহান ছিলেন। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তিনি সবার আগে গিয়ে কর্ম সম্পাদন করেছেন। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তিনি তার সৎকার করতেন।

ছোট ছেলে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে রাধাগোবিন্দ চৌধুরী

চঞ্চল চৌধুরীর বাল্য বন্ধু তোফাজ্জল হোসেন তোফা বলেন, তিনি আমার একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। চঞ্চলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে তাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমরা বাড়িতে গেলে নিজেই ঘর থেকে সব কিছু বের করে খাওয়াতেন। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। বাবার মতো করে সবাইকে আদর করতেন। মোটকথা ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে সব সময় আগলে রাখতেন। আমরা তার মতো মানুষ হতে চাই।

তিনি আরও বলেন,  আমাদের এলাকায় প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে তিনি বই পড়ে পড়ে আমাদের দিক-নির্দেশনা দিতেন আর আমরা অভিনয় করতাম। তিনি এলাকার অনেক মানুষের সাংস্কৃতিক চর্চারও গুরু ছিলেন। তার থেকে অনেক মানুষ অভিনয় শিখেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান বলেন, আমি রাধাগোবিন্দ স্যারের ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা-মাও তার শিক্ষার্থী ছিলেন। স্যারের আদর্শ পেয়েই আজ আমরা আলোর পথ পেয়েছি। তার কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না। 

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শহিদুর রহমান খান বলেন, আমাদের এলাকায় শিক্ষার আলো তিনি ছড়িয়েছিলেন। তিনি আমাদের এলাকাকে নিরক্ষরমুক্ত করেছেন। এলাকার এমন কোনো বাড়ি নেই তার দুই-তিন জন করে ছাত্র নেই। অনেক ছাত্র দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। তিনি আমাদের এলাকার একজন বাতিঘর ছিলেন। স্যারের স্কুলে যখন পড়তাম, তখন রাতে হঠাৎ হেরিকেন জ্বালিয়ে তিনি ছাত্রদের বাড়িতে যেতেন যে ঠিকভাবে পড়াশুনা করছে কিনা। তিনি এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।

রাধা গোবিন্দ চৌধুরীর সহকর্মী কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক কোরবান আলী বলেন, তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সব বিষয়ে তিনি জ্ঞান রাখতেন। সেই সময়ে মেট্রিকুলেশন পাস করলেও সব বিষয়ে এমন জ্ঞান ছিল যে মনে হতো তিনি একজন বিজ্ঞানী। সহকর্মী হিসেবে তিনি আমাদের সঙ্গে অমায়িক ব্যবহার করতেন। আমাদের যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে আমরা স্কুল পরিচালনা করেছি। আমরা তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

গত মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর)  সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে রাধাগোবিন্দ চৌধুরী ঢাকার একটি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) পাবনার সুজানগর উপজেলার কামারহাটে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

আরএআর