বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন নোয়াখালীর দুই ভাই। বড় ভাই মো. মহিউদ্দিন মুরাদ (৪৩) ও ছোট ভাই মো. মিলন উদ্দিনের (৪০) সাফল্য দেখে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন অনেক তরুণ। 

মুরাদ ও মিলন নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আদর্শ গ্রামের মৃত মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজেদের পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই কাঁকড়া চাষে পেয়েছেন সফলতা। এই কাঁকড়া রাজধানী ঢাকা হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

জানা যায়, ২০০৬ সালে মাছ ধরতে গিয়ে প্রথম কাঁকড়া শিকার করেন বড় ভাই মুরাদ। তারপর তা পুকুরে বড় করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। কিছুদিন পর এক পর্যটক নিঝুম দ্বীপে ঘুরতে আসলে দেখা হয় মুরাদের সঙ্গে। পর্যটকের পরামর্শ অনুযায়ী কাঁকড়া রপ্তানি করতে শুরু করেন চায়না-সিঙ্গাপুর-হংকংসহ নানা দেশে। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।

কাঁকড়ার খামারে ঘুরে দেখা যায়, নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আদর্শ গ্রামের প্রধান সড়ক ঘেষে বেশ কয়েকটি পুকুর জাল দিয়ে ঘেরা। এগুলো কাঁকড়া চাষের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি। প্রতিটি পুকুরের পাড়ে রয়েছে নানান রকমের শাকসবজির গাছ। মেঘনা নদী কূল থেকে আহরণ করা কাঁকড়াগুলো এসব পুকুরে মোটাতাজা করা হয়। 

মহিউদ্দিন মুরাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে এই কাঁকড়া ধরা ও চাষের সঙ্গে যুক্ত হই। প্রথমদিকে নোয়াখালীর মধ্যেই কাঁকড়া বিক্রি করতাম। নিঝুম দ্বীপ ঘুরতে আসা এক পর্যটকের পরামর্শে রাজধানী হয়ে দেশের বাইরে পাঠাচ্ছি। প্রথমে মাসে ৩০০ কেজি থেকে ৪০০ কেজি বিদেশে রপ্তানি করতাম। বর্তমানে ৭০০ কেজি থেকে ৮০০ কেজি রপ্তানি করছি।

তিনি আরও বলেন, ৩ কড়া (১ গন্ডা) পুকুরে প্রথম কাকড়া চাষ করেছি। বর্তমানে বড় বড় ৫টি পুকুর আছে। আমার ছোট ভাই মিলনসহ আমরা পুরো খামার দেখাশোনা করি। আমার ১০০ এর অধিক কাকড়া আহরণকারী আছে। তাদের কাছ থেকে একটি কাঁকড়া ৪০ টাকায় কিনলে তা কিছুদিন মোটাতাজা করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে পারি। আমাকে দেখে অনেকে পরামর্শ নিয়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন নতুন কাকড়া চাষি তৈরি হয়েছে। তারাও রপ্তানি করছে। করোনা মহামারিতে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ ছিল। তখন কোনো সরকারি সহযোগিতা পাইনি।

দুই ভাই

ছোট ভাই মিলন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিঝুম দ্বীপ থেকে একমাত্র কাঁকড়াই বিদেশে যাচ্ছে। আমাদের খামারের মাধ্যমে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমাদের দেখে নতুন খামারি আসছে। হাতিয়া সারাবিশ্বে পরিচিত হচ্ছে। এটা আমাদের ভালো লাগা।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়মের বাসিন্দা মো. ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মুরাদ ভাই দীর্ঘদিন ধরে নিঝুম দ্বীপে কাঁকড়া চাষ করছেন। তাকে দেখে অনেকেই এই চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। নিঝুম দ্বীপ থেকে একটি মাত্র পণ্য এটি যা দেশের বাইরে যায়। এতে আমরা গর্বিত। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাহলে তারা আরও এগিয়ে যেতে পারবে। 

সাইফুল ইসলাম নামের এক প্রতিবেশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপকূলের মানুষের জন্য অন্যান্য ব্যবসায় ঝুঁকি আছে কিন্তু কাঁকড়া ব্যবসা নিরাপদ। উনাকে অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। কাঁকড়া চাষে যুক্ত হওয়ার পর তিনি উন্নতি করেই যাচ্ছেন।

নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আফছার দিনাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিঝুম দ্বীপে অনেক কাঁকড়া চাষি আছেন। তাদের মধ্যে মুরাদ অন্যতম। কাঁকড়া চাষে তিনি খুব ভালো করছেন। তবে সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকলে উনি আরও ভালো করতেন।

উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব প্রধানমন্ত্রী। তিনি কৃষিকে সব থেকে বেশি প্রাদান্য দিচ্ছেন। বিশ্ব দরবারে হাতিয়ার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে কাঁকড়া চাষিদের যেকোনো প্রয়োজনে আমরা উপজেলা পরিষদ আছি। আরও সহজে কীভাবে রপ্তানি করে বেশি বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করা যায় তার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

হাতিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাজু চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাঁকড়া চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। কারণ কাঁকড়া একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য। চীন, আমেরিকাসহ ইউরোপে কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সঠিকভাবে চাষ করে রপ্তানি করতে পারলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও স্বাবলম্বী হবে। নিঝুমদ্বীপসহ হাতিয়ায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কাঁকড়া চাষিদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যায় কিনা তা নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতিয়ার সম্ভাবনাময় দ্বীপ হচ্ছে নিঝুম দ্বীপ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটি পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। একইভাবে মাছ ও কাঁকড়ার জন্য এটি অনেক সম্ভাবনাময় ইউনিয়ন। করোনার কারণে সফল উদ্যোক্তা মুরাদ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন আবার তার ব্যবসায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কৃষি ও মৎস্য বিভাগের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের আরও দক্ষ করা গেলে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। 

হাসিব আল আমিন/আরকে