‘মোর পরিবারের ছয়জন সদস্য। এই ভ্যানডার উফরে (আয়ে) হগলডি চলে। পরশু রাইতে নাহইল (নারিকেল) গাছের তলায় থুইয়া গেছি; বেইন্যাহালে (সকালে) আইয়্যা দেহি ভাঙা। এহনতো মোর সংসার চালাইন্যা কোনো উপায় নাই।’ বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সকালে ভেঙে ফেলা বরিশাল মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথাই জানাচ্ছিলেন হামেদ মোল্লা।

সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড বালুর মাঠের সরকারি জমিতে ঘর তুলে থাকেন ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ। তার সংসার চলতো ভ্যান চালিয়ে। কিন্তু মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব ভেঙে ফেলার রাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। এরপর দুদিন ধরে সেখানেই ভাঙা ভ্যানটি নিয়ে অপেক্ষা করছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর অপেক্ষায়। মেয়র এখানে কখন আসবেন তাও জানেন না হামেদ মোল্লা। যদি এসে পড়েন তাহলে ভ্যানটি দেখিয়ে সাহায্য চাইবেন এই আশায়।

হামেদ মোল্লা বলেন, আমার গাড়িটি যদি মেরামত কের দিত বা একটি নতুন গাড়ি যদি দিত তাহলেই আমার উপকার হতো। আমার ৭ জনের পরিবারে আয়ের কোনো পথ নেই। ভ্যানটি ভেঙে ফেলার পর আজ পর্যন্ত আমার রোজগার নেই। মানুষের কাছ থেকে ধার করে দুদিন বাজার করেছি। এরপর কীভাবে চলব তা জানি না। আর ভ্যান মেরামতেরও কোনো টাকা নেই।

তিনি বলেন, ভ্যান গাড়িডা এইহানে রাখছি—মেয়রে যদি আয়—তারে ধইর‍্যা যদি কোনো সাহায্য লইতে পারলে গাড়িডা হাইর‍্যা (মেরামত) লইতে পারতাম। আমার লগে কোন মোবাইল নাই—এজন্য মেয়রের অপেক্ষায় বইয়া রইছি। হে (সে) আয় যদি তাহলে সাহায্যের কতা কইতে পারতাম।

জানা যায়, ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় মূল বাড়ি হামেদ মোল্লার। অভাবে পড়ে অনেক বছর আগেই বরিশালে এসেছেন জীবিকার সন্ধানে। এর আগে দিনমজুরের কাজ করতেন। সেই টাকা জমিয়ে ভ্যানটি কিনেছিলেন তিনি। তিন মেয়ে, দুই ছেলে এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ৭ জনের সংসারের মূল আয়ের উৎস তার ভ্যান। বরিশাল কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের সামনের সড়কে থাকতেন অন্যান্য দিন। দিনে বিভিন্ন দোকানের পণ্য আনা-নেওয়া করে রাতে মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সীমানার মধ্যে থাকা নারিকেল গাছের সঙ্গে তালা ঝুলিয়ে রেখে যেতেন ভ্যানটি।

অন্যান্য দিনের মতো গত মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ভ্যানটি সেখানেই তালা ঝুলিয়ে রেখে যান। কিন্তু বুধবার ভোরে এসে দেখেন ভ্যানটি ভাঙা। এর মধ্যে ওপরের চাতাল আর একটি চাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে ভ্যানটি চালানো পুরোপুরি অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর আশায় বুধবার পুরোদিন মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের ধ্বংসস্তুপের ওপর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আবার আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এসে অপেক্ষা শুরু করেন হামেদ মোল্লা। তবে ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত এই বৃদ্ধকে কথা বলতে দেখে শহীদ মিনার ও বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিটি করপোরেশনের কর্মীরা তাকে ওই এলাকা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছেন বলে জানা গেছে।

হামেদ মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, আপনার (প্রতিবেদক) লগে কথা কইয়া মোর আরও ক্ষতি হইলো। এহন কর্তৃপক্ষ মোরে এই এলাকা থেইক্যা বাইর কইর‍্যা দিছে। কইছে অন্য এলাকায় গিয়া থাকতে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক আহম্মেদ বলেন, উচ্ছেদের সময়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা জানা নেই। যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তার পাশে সিটি করপোরেশন অবশ্যই থাকবে। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মেয়র বরাবর লিখিত আবেদন করলে আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব। যদি তিনি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হন অবশ্যই তাকে সাহায্য করা হবে।

প্রসঙ্গত, ১৯৪২ সালে ৩০ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বরিশালের মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব মঙ্গলবার রাতের আঁধারে গুড়িয়ে দেয় বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি)। ক্লাবটিকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াঙ্গনে এক সময়ে জৌলুস ছিল। তবে ২০১৪ সালের পর নতুন করে কোনো কমিটি হয়নি। ক্লাব সদস্যরা অভিযোগ করেন, বিনা নোটিশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্লাবটিকে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে