উত্তরের বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিচিত নীলফামারীর সৈয়দপুর। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর অনেক আগে থেকে প্রসিদ্ধ হলেও রেলের শহর হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত। সৈয়দপুরে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনা রেলওয়ে ব্রিজ ওয়ার্কশপ বা সেতু কারখানা। তবে জনবলের সংকট, দীর্ঘদিন আধুনিকায়ন না হওয়া ও তদারকির অভাবে খোলা আকাশের নিচে নষ্ট হচ্ছে রেলের হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারণা না থাকায় পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে আগাছায়। এ অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা হাজার কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি যেন খেয়ে ফেলছে মাটি ও আগাছা। এছাড়া জরাজীর্ণ অফিসঘর এবং বিশাল উচ্চতার শেডের মেঝেতে পাঁচটি বড় এয়ার কম্প্রেসারসহ বেশ কয়েকটি মূল্যবান মেশিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

রেলসূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিন দেশের রেল নেটওয়ার্ক ছিল একই। রেল ব্যবস্থাকে স্বনির্ভর করতে ও রেলসেবা নির্বিঘ্ন করতে গড়ে তোলা হয় বিশাল এই রেল সেতু কারখানা। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েকে ঘিরে ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমিতে স্থাপন করা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। একই সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম এ বৃহৎ কারখানাটির অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিমাংশে প্রায় ১৮ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় ব্রিজ ওয়ার্কশপ তথা সেতু কারখানাটি। মূলত ব্রডগেজ, মিটারগেজ, রেলপথের ব্রিজ এবং রেলপথের পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং ও গার্ডার ইয়ার্ড তৈরির জন্যই এ সেতু কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল। শুরুতে এ কারখানার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মেশিন শপ, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং শপ ও গাডার ইয়ার্ড শপ নামে তিনটি উপ-কারখানায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করত। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সব স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম শেডের মালামাল, রেললাইনের পয়েন্ট অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজ গার্ডার, ট্রলি ও মোটরট্রলি মেরামত এবং তৈরি, মোর গার্ডার, পানির ট্যাংক, ফুটওভার ব্রিজের মালামাল, ট্যাং স্টেজিংসহ ১০০ ধরনের মালামাল তৈরি হতো এ কারখানায়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কারখানাটিতে প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে রেলওয়ের ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে 'গোল্ডেন হ্যান্ডশেক' ঘোষণা দিলে ওই সুবিধা নিয়ে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে অবসরে যান। পরবর্তীতে মঞ্জুরিকৃত ১২৭টি পদের মধ্যে নিয়মিত অবসরে যেতে যেতে মাত্র ছয়জন শ্রমিক-কর্মচারীতে নেমে আসে। ফলে ২০১৪ সালে এটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানে স্টোরকিপার, অফিস সহকারী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী তিনজন মিলে কারখানাটি দেখভাল করছেন। দায়িত্বে থাকা সহকারী সেতু প্রকৌশলী নিয়মিত কর্মস্থলে আসেন না। এছাড়া কাগজ-কলমে সেতু কারখানাটির নির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রকৌশলী মো. আবদুর রহিমের নাম থাকলেও তিনি রেলওয়ের পাকশী বিভাগে কর্মরত রয়েছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, কারখানার প্ল্যাটফর্ম শেড তথা নকশা ঘর তালাবদ্ধ। ভেতরে আবর্জনার স্তূপ। পাশে থাকা মেশিন শেড এর চিত্র একই। অর্থাৎ পুরো এলাকায় তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু আগাছার ঝোপঝাড়। খোলা আকাশে মাটির ওপর পড়ে আছে অ্যাঙ্গেল, রড, স্কয়ার রড, কভার প্লেট, মিটার ও ব্রডগেজ লাইনের সেতুর স্পেয়ার গার্ডার, তিস্তা ও পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়, রেললাইনের পাত, একটি বিকল স্টিম ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের লোহার সামগ্রী। এগুলো দীর্ঘদিন বিক্ষিপ্তভাবে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় মাটির আস্তরে এবং আগাছায় ঢেকে গেছে। এরই মধ্যে অনেক মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।

২০১৪ সাল পর্যন্ত রেলের বিভিন্ন সেতু, কালভার্ট, ব্রিজ এখানকার উৎপাদিত মালামাল দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা মেরামত হয়েছে। কারখানাটির মেশিনগুলো ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা, জাপান আর ফ্রান্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতিটি মেশিনের দাম কয়েক কোটি টাকা করে। কোনো কোনো ভারি মেশিনের দাম আছে কয়েকশ কোটি টাকা পর্যন্ত। আশি-নব্বইয়ের দশকে এই কারখানা রেলের নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে উৎপাদিত মালামাল বাইরেও বিক্রি করত। এতে রেল প্রতিবছর আর্থিকভাবে লাভবানও হতো বেশ।

রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রেলের নতুন সেতু নির্মাণ কিংবা ছোট-বড় সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার অধিক মালামাল কিনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। বিগত ৮ বছরে প্রায় ১ হাজার কোটির টাকা মালামাল কিনতে হয়েছে বিদেশ থেকে। যেসব মালামাল একসময় এখানে উৎপাদন করা হতো তার সবাই এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। অথচ শুধু লোকবলের অভাবে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চালু করা যাচ্ছে না রেলওয়ে সেতু কারখানা।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওই কারখানার অবসরপ্রাপ্ত এক উপ-সহকারী প্রকৌশলী বলেন, অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা এসব মালামালের বর্তমান আনুমানিক মূল্য ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া জরাজীর্ণ অফিসঘর এবং বিশাল উচ্চতার শেডের মেঝেতে পাঁচটি বড় এয়ার কম্প্রেসার মেশিন, তিনটি ওয়েল্ডিং প্লান্ট, উইন্স ক্রাব, তিনটি ডাইস মেশিন, দুটি লেদ মেশিন, বিদ্যুৎচালিত বেল্ড ড্রাইভিং তিনটি, একটি প্লেট কাটিং তথা সেয়ারিং মেশিন, দুটি বড় হেমার মেশিনও পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানার সহকারী সেতু প্রকৌশলী জুয়েল মিঞা বলেন, জনবল সঙ্কট ও কাঁচামালের অভাবে প্রায় আট বছর ধরে সেতু কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া কারখানার অধিকাংশ মেশিনপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ ও নষ্ট হয়ে গেছে। এটিকে নতুনভাবে চালু করতে কয়েক হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিক বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।

উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন বলেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া সেতু কারখানার কোটি কোটি টাকার মেশিন ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও সামান্য আধুনিকায়ন করা হলে এটি পুনরায় সচল করা সম্ভব হবে।

রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন কারখানা শাখার সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কারখানাটি রক্ষার জন্য সম্মিলিত ট্রেড ইউনিয়ন এখন ঐক্যবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করা সম্ভব নয়। আমরা কারখানাটি রক্ষার জন্য খুব তাড়াতাড়ি আন্দোলনে যাচ্ছি।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ডিভিশনাল সুপারিনটেন্ডেন্ট (ডিএস) সাদেকুর রহমান বলেন, বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন আশা করছি।

শরিফুল ইসলাম/আরকে