খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে হুমকির মুখে পিরোজপুরের পোল্ট্রি শিল্প
প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে পোল্ট্রি খাবার ও ওষুধের দাম। ফলে দেশের অধিকাংশ ডিমের চাহিদা পূরণকারী পিরোজপুরের অনেক মুরগির খামার ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বেকারত্ব। অন্যদিকে পোল্ট্রি খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে খামার বন্ধ হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ সহস্রাধিক পরিবার হুমকির মুখে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের আমিষ চাহিদা পূরণে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উপকূলীয় জেলা পিরোজপুর। পাশাপশি বর্তমান সময়ের অধিক দামের মাছ ও মাংসের বিকল্প হিসেবে মুরগির ডিম সরবরাহকে সচল রেখেছে এ জেলা। অন্যদিকে পোল্ট্রি খাদ্যসহ সংশ্লিষ্ট সকল কিছুর মূল্যবৃদ্ধি ও সরকারি তদারকির অভাবে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে জেলার আয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য খাত পোল্ট্রি শিল্প। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার প্রায় শতাধিক পোল্ট্রি খামার। ফলে একদিকে যেমন দেনায় জর্জরিত হয়েছেন খামার মালিকরা, অন্যদিকে মূলধন আটকে গেছে খাবার সরবরাহকারীদের।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সর্বশেষ এক মাসে খাবারের দাম কয়েক দফায় বস্তা প্রতি দুই শতাধিক টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। খাবারের দাম বাড়ায় ও ডিমের দাম কমায় আর্থিক সংকটে পড়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার কয়েকশ মুরগির খামার। ফলে দেনায় জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হবার পর্যায়ে খামার মালিকরা।
এছাড়া খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে ডিমের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে পোল্ট্রি খামারিদের সঙ্গে বাজারে ডিমের মূল্য নির্ধারণকারীদের সমন্বয় না থাকায় লোকসানে পড়ছেন খামারিরা। ফলে ঋণের পাল্লা ভারী হওয়ায় পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। তবে খামারিদের পরামর্শসহ বিভিন্ন সহায়তা করছে প্রাণীসম্পদ বিভাগ।
বিজ্ঞাপন
আলাউদ্দিন নামের এক শ্রমিক বলেন, সর্বশেষ এক বছরে খাবার ও ঔষধের দাম অনেক বেড়েছে। যে খাবার ২২০০ টাকা কিনতাম সেই খাবার এখন খামার পর্যন্ত আসতে ৩৭০০ টাকা খরচ হয়। মুরগি লালন পালনের ইচ্ছা উঠে গেছে আমাদের। ব্যবসার যে অবস্থা তাতে খামার মালিকরা আমাদের ঠিকমতো বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই তারা শ্রমিকদের কাজ থেকে ছাঁটাই করে দিচ্ছেন। এতে বহু মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে।
আরেক শ্রমিক রাবেয়া বেগম বলেন, আগে খামারে কাজ করে শেষ করতে পারতাম না। এখন কাজের চাপ কমে গেছে অনেকটা। ফার্মের সাথে সাথে মুরগীও কমে যাচ্ছে দিন দিন। যে অবস্থা তাতে কতদিন কাজ করে টিকতে পারি জানি না। সরকার যদি খামারীদের ঠিকমতো না দেখে তাহলে কাজ করে আমাদের বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।
পোল্ট্রি খামার মালিক আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের পিরোজপুর জেলায় কয়েক হাজার পোল্টি খামার রয়েছে। বিগত ছয় মাসে খাবারের দাম বস্তা প্রতি ১ হাজার টাকা করে বেড়েছে। উৎপাদন করতে আমাদের যেমন খরচ হচ্ছে গোস্ত ডিম বিক্রি করতে গেলে আমরা সেই দাম পাচ্ছি না। যাতে আমাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে এবং যেগুলো বাকি আছে সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধের পথে। অনেক পরিবার আছে যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িয়ে নিজেদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে, তারা বেকার হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে খামার শিল্পটি ধ্বংসের মুখে পড়বে। এ নিয়ে আমরা খামারিরা হুমকির মুখে রয়েছি।
আরেকটি পোল্ট্রি খামারের মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, মুরগির ডিমের দাম বাজার থেকে আমাদের নির্ধারিত করে দেয়া হয়। একদিকে খাবার ও ঔষধের দাম বাড়ছে অন্যদিকে ডিম বিক্রি করে আমরা প্রয়োজন মত দাম পাচ্ছি না। ডিম উৎপাদনে খরচ হয় দশ টাকা সেখানে বাজারে ডিম বিক্রি করছি সর্বোচ্চ ৭ টাকা ৮০ পয়সা বা ৮ টাকা। ডিমের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ জরুরীভাবে প্রয়োজন। খামারিরা ঋণগ্রস্থ হওয়ার কারণে এই ব্যবসা অনেকেই বন্ধ করে দিচ্ছে। আমরা ব্যবসা প্রসারের ক্ষেত্রে শুনে থাকি ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ দেয় কিন্তু এই ব্যবসায় ঝুঁকি আছে বলে ব্যাংকে গেলে আমরা ঠিকমতো ঋণও পাই না।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তরুণ কুমার সিকদার বলেন, পিরোজপুর জেলায় ৫ হাজারের বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে। যার সঙ্গে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যারা এই কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। পিরোজপুরে যে খামারগুলো রয়েছে তা থেকে বছরে প্রায় ৪৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। যা থেকে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ডিম ও গোশতের চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু বর্তমানে খাবারের বাড়তি দামের কারণে ডিমের যে উৎপাদন খরচ তার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা মূল্য সামঞ্জস্য নয়। যারা বাজারে ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে তাদের সাথে সমন্বয় করে বিক্রি করলে খামারিরা লাভবান হবেন বলে আমি মনে করি। উপকূলীয় চরাঞ্চল প্রাণিসম্পদ সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প'র আওতায় প্রতি ইউনিয়নে ৫ শত উপকারভোগী খামারি নির্বাচিত হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রান্তিক চাষীরা উপকৃত হবে বলে আশা করছি। আমাদের জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ খামারীদের বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিযে সহযোগিতা করে থাকে।
মো: আবীর হাসান/আরকে