বাঁশিতেই চলে খোকন মিয়ার জীবিকা
নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের যেকোনো গানের আসরে গেলেই দেখা মিলে কর্নেট বাঁশিওয়ালা খোকন মিয়ার। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে এই কর্নেট বাঁশিই সানাই বাঁশি বলে পরিচিত। তাই খোকন মিয়া নিজ এলাকাসহ আশপাশের সংগীত প্রিয় লোকজনের কাছে ভালোমানের একজন সানাই বাদক হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।
স্থানীয় যাত্রা-নাটক এবং গ্রামীণ বিভিন্ন ঝুমুর যাত্রাপালা থেকে শুরু করে বাউল গান, গাজীর গীত, কিসসা গান ও বিয়ের অনুষ্ঠানসহ নানা রকম অনুষ্ঠানে প্রয়োজন পড়ে বাঁশিওয়ালা খোকন মিয়ার। নিজ জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঁশি বাজাতে যেতে হয়। তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করেছেন দেশবরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী কুদ্দুস বয়াতীর সঙ্গে। সহায়-সম্পদ বলতে বসতভিটা ছাড়া কিছুই নেই খোকন মিয়ার। বাঁশিই তার একমাত্র সম্পদ এবং এই বাঁশি বাজিয়েই তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বিজ্ঞাপন
তবে খোকন মিয়া তার জীবনের দীর্ঘ সময় বাঁশি বাজিয়ে মানুষের মন জয় করলেও ঘুরেনি তার ভাগ্যের চাকা। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বর্তমানে বহু কষ্টে দিন কাটছে তার। বাঁশি বাজিয়ে স্ত্রী, চার ছেলে ও দুই মেয়েসহ আট সদস্যদের পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারছেন না তিনি ।
সম্প্রতি কথা হয় ৫১ বছর বয়সী কর্নেট বাঁশিওয়ালা খোকন মিয়ার সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে আসে তার অতীত এবং বর্তমান জীবনের নানা কাহিনী।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, ১৯৭০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি নেত্রকোনার মদন উপজেলার নায়েকপুর ইউনিয়নের রাজতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছমেদ আলী ও মা কমলা আক্তার। বাবা ছমেদ আলীও একজন নামকরা কর্নেট বাঁশিওয়ালা ছিলেন। খোকন মিয়া যখন খুব ছোট তখন থেকেই বাবার বাঁশি দেখে তারও বাশি বাজাতে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সুযোগ পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার বাঁশিটি বাজাতেন। কিন্তু তার বাবা কিছুতেই চাইতেন না ছেলেও তার মতো বাঁশিওয়ালা হোক।
তারপর খোকন মিয়া মোহনগঞ্জ উপজেলার এক বাঁশিওয়ালার কাছে গিয়ে কিছুদিন তালিম নেন এবং একপর্যায়ে নিজে নিজে বাজিয়ে বাঁশি বাজানো ভালোভাবে রপ্ত করেন। ১১-১২ বছর বয়সে কর্নেট বাঁশি বাজানো সম্পূর্ণ শিখে ফেলেন খোকন মিয়া। পরে তিনি এলাকার ছোটখাটো অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়ে প্রশংসা পেতে শুরু করেন। প্রথমদিকে বাঁশি বাজানোর বিনিময়ে যে যত টাকা দিতেন তাই নিতেন। পরে এই বাঁশি বাজানোকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। বর্তমানে তিনি কোনো অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজালে ১-২ হাজার টাকার মতো পান। এই টাকা দিয়ে কোনো রকম চলছে তার সংসার।
খোকন মিয়া বলেন, বাঁশি বাজানো ছাড়া অন্য কোনো কাজই আমি করতে পারি না। তাই কষ্ট করে চললেও এটাই করছি। বাঁশি বাজিয়ে কোনো আয় উন্নতি করতে পারিনি। কোনো রকম সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। করোনার কারণে গত কয়েক মাস কোনো অনুষ্ঠান না হওয়ায় খুব কষ্টে আছি। তবে এখন আবার অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে। তাই আমার চাহিদাও বাড়ছে।
তিনি বলেন, করোনার সময় সরকার কত শিল্পীকে অনুদান দিয়েছে। কিন্তু আমি কিছুই পাইনি। সরকার যদি আমাকে একটু সহযোগিতা করতেন তাহলে হয়তো আমার পরিবারের কষ্টটা কিছু্ কমতো এবং আমি ঐতিহ্যবাহী এই পেশােটাকে ধরে রাখতে পারতাম। কারণ আগে আমার এলাকায় অনেকেই এই বাঁশি বাজিয়ে জীবন চালাতেন। কিন্তু তারা আজ নেই। একমাত্র আমিই এখনো টিকে আছি। বাকি জীবনও বাঁশি বাজিয়ে মানুষের মনে আনন্দ দিয়ে যেতে চাই।
এ বিষয়ে নেত্রকোনা জেলা যাত্রা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মো. দিদারুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, শুধু যাত্রা-নাটকই নয়, প্রত্যেকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই কর্নেট বাঁশির একটা আদালা আবেদন রয়েছে। এ বাঁশির সুর মানুষকে বিমোহিত করে। খোকন মিয়াকে আমি ভালোভাবে চিনি। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজিয়েই জীবন চালাচ্ছেন। খুব দক্ষ একজন বাঁশিওয়ালা তিনি। শুধু খোকন মিয়া নয়, তার মতো অসংখ্য লোকশিল্পী বিশেষ করে যাত্রাশিল্পীদের বর্তমানে চরম দুর্দিন চলছে। তাই অসহায় এসব লোকশিল্পীদের জীবনমানের উন্নয়নে সরকারিভাবে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
দেশবরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী কুদ্দুস বয়াতীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, বাঁশিওয়ালা খোকন আমার দীর্ঘদিনের সহকারী। আমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সে অন্যদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজায়। পাশাপাশি আমার সঙ্গেও কাজ করেন। নেত্রকোনা অঞ্চলের কর্নেট বাঁশিওয়ালাদের মধ্যে একমাত্র খোকন মিয়া এখনো টিকে আছে। তাকে ধরে রাখা আমাদের সবারই উচিত।
তিনি বলেন, আমি সারাদেশের অসহায় লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজ করে আসছি। আমি জানি, তারা কতটা কষ্ট করে লোকসংস্কৃতিকে ধরে রাখছে। তারা অনেকেই সংসার চালাতে পারছে না। আবার অনেকে রোগে ভুগছে। আমি আশা করি এই লোকশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কারণ এই শিল্পীরা বেঁচে না থাকলে লোকসংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে। আর লোকসংস্কৃতি বিলীন হয়ে গেলে এদেশের মূল পরিচয় বলতে কিছুই থাকবে না।
এ নিয়ে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আব্দুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে অনেক শিল্পীই সহায়তা পাচ্ছেন। তবে যারা এখনো পাননি তাদেরও এ সহায়তা প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা নেত্রকোনা জেলার লোকশিল্পীদের একটা তালিকা তৈরি করব এবং এ তালিকা অনুযায়ী যারা সরকারি সহায়তা পাননি তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা দেওয়া হবে।
এমআইএইচ/এসপি