রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় একজন ‘রাজাকার’কে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানেরা। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির নাম ইসমাইল হোসেন গাইন।

শুক্রবার বিকেলে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে) কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ইসমাইল হোসেন গাইনকে রাজাকার দাবি করে তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার গেজেট থেকে বাতিল করার দাবি জানানো হয়।

এছাড়া রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনের ছেলে জিল্লুর রহমান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এমপি (রাজশাহী-৪) ইঞ্জিনিয়ার মো. এনামুল হকের প্রভাব খাটিয়ে এই কাজ করেছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন মিলমালত। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ইতোমধ্যে অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তাদের জীবন দানের মাধ্যমে আমাদের একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন। গত এক যুগের অধিক সময় থেকে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্বার্থন্বেষী কিছু নেতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের কিছু ব্যক্তিকে বীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেটে সম্প্রতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজশাহীর বাগমারায় সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। এতে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, ইসমাইল গাইনের ছেলে জিল্লুর রহমান স্থানীয় এমপি (রাজশাহী-৪) এনামুল হকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ২০২১ সালের ১৫ জুন বাগমারা উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনের নাম জামুকায় (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) প্রেরণ করে। ইসমাইল গাইন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় জিল্লুর রহমান এমপি এনামুলের মিডিয়া কর্মকর্তা ছিলেন।

এদিকে ইসমাইল হোসেন গাইন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিজেদের সম্মানহানি ঘটেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এ ঘটনায় মহান মুক্তিযদ্ধের বিরোধী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ইসমাইল হোসেন গাইনকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তারা বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই উপজেলা কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। লিখিত অভিযোগে বাগমারার শতাধিক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং এলাকাবাসী স্বাক্ষর করেছেন।

বাগমারার শ্রীপুর গ্রামের মৃত মকিম উদ্দিন গাইনের ছেলে ইসমাইল হোসেন গাইন রাজাকার বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হোসেনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাগমারায় মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ইসমাইল হোসেন মৃধা। ওই সময়ে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হোসেনের নেতৃত্বে ইসমাইল গাইন, ইয়াসিন এবং ইসাহাকসহ ওই এলাকার রাজাকাররা বাগমারায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন মৃধার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়।

এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মছির উদ্দিন গাইন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শমসের উদ্দিন, ইউসুফ বকসের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়। এসময় তারা বাগমারার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করেন। ইসমাইল হোসেন গাইন এবং তার সহযোগীদের কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগমারা এলাকার মানুষ আতঙ্কিত থাকতেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জামুকা’র মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর স্থানীয় নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবারের সদস্য এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্য ইসমাইল হোসেন গাইনকে গত বছরের ১৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ঢাকায় ডাকেন। এরপর মন্ত্রী উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানির সময় ইসমাইল হোসেন গাইনের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তৎকালীন ইউএনও ফারুক সুফিয়ান তদন্ত শুরু করেন। তিনি যুদ্ধকালীন কমান্ডার আলী খাজা এম এম মজিদসহ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করেন। নির্যাতিতরা ইসমাইল হোসেন গাইনের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সর্ম্পকে লিখিতভাবে জানান। এরপর ইউএনও ফারুক সুফিয়ান নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলায় বদলি হয়ে যান। তিনি বদলি হওয়ার পর তদন্তের গতি থেমে যায়। নতুন ইউএনও সাইদা খানম যোগদান করেন। তিনি নতুন করে তদন্ত শুরু করেন। তবে ইউএনও সাইদা খানম তার রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। ওই তদন্তের সময় বাগমারার যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী খাজা এমএ মজিদ তার সাক্ষ্যে বলেন, ইসমাইল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিনা সেটি আমার জানা নেই। আমি তাকে চিনতাম না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ডেপুটি কমান্ডার খয়বার হোসেনও জানিয়েছেন, তিনিও ইসমাইল হোসেন গাইনকে চিনেন না এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেখেননি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় প্রশিক্ষক দীপপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন- ইসমাইল হোসেন গাইন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি প্রশিক্ষণে অংশও নেননি।

এছাড়াও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়ানুচ আলীও লিখিতভাবে জানিয়েছেন, ইসমাইল হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেন এবং লুটপাট চালান। একইভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী, আব্দুস সালাম, ইউসুফ আলী খন্দকার বুলবুল ও আব্দুল খালেক শাহানাও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসমাইল হোসেন গাইন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ময়েজ উদ্দিন মিলমালত বলেন, সর্বশেষ ইসমাইল হোসেন গাইনকে ডিও লেটার দেন বাগমারার এমপি প্রকৌশলী এনামুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জামুকায় শুনানির দিন ধার্য্য করা হয়। আমরা সেখানে উপস্থিত হলে সেখানকার কর্মকর্তারা জানান, এমপি এনামুলের উপস্থিতিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের সময় আমাদের সহযোদ্ধারা দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। রক্তের বিনিময়ে আমরা এ ভূখণ্ড পেয়েছি। আমরা অবিলম্বে কুখ্যাত রাজাকার ইসমাইল হোসেন গাইনের গেজেট বাতিলের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী, আব্দুস সালাম, ইউসুফ আলী খন্দকার বুলবুল এবং বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান খোদা বক্স, ফজুলর রহমান, আলী, আজাজুল ইসলাম প্রমুখ।

ইসমাইল হোসেন গাইনকে ডিও লেটার প্রদানের বিষয়ে এমপি ইঞ্জিনিয়ার মো. এনামুল হককে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, এমপি ডিও লেটার দিলেই কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকে যায় নাকি? যাচাই-বাছাই হয় না? আর ডিও লেটার কি শুধু ইসমাইল হোসেনকে দিয়েছি নাকি? যারা অভিযোগ করছে তাদেরকেও দিয়েছি।

আশিক/টিএম