কর্মচারীদের দৈনিক ১৫০০ টাকা দেন তৃতীয় লিঙ্গের বাকী
আবদুর রহমান বাকী। তার শৈশব আর দশটা ছেলেশিশুর মতো ছিল না। মেয়েশিশুদের সঙ্গে পুতুলখেলা নিয়েই কাটে তার শৈশব। কৈশোরে সঙ্গী হন যাত্রাদলের। পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে যাত্রাদলে অভিনয় করতেন মেয়ে চরিত্রে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকেন তিনি। স্রোতের বিপরীতে চলতে থাকা আচার-আচরণে বাকীর পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন হয় শারীরিক অঙ্গভঙ্গি আর কণ্ঠের।
তখন বাকী হার মানেন সমাজ-সংস্কৃতির কাছে। বাধ্য হন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে। ততক্ষণে বাকী সমাজের কাছে পরিচিতি পান তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে। তবে বিচলিত না হয়ে নিজের এই পরিচয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন বাকী। ক্লেদ, দুঃখ ও বঞ্চনাকে সঙ্গী করে স্বপ্ন দেখেন দিনবদলের। কর্মসংস্থান আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টার সঙ্গে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজতে থাকেন।
বিজ্ঞাপন
নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে কিছুদিন ঝাড়ুদারের কাজ করেন। পরে রান্নাবান্নার কাজও করেন। এভাবেই বাকীর কেটে যায় ১৮টি বছর। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে ওঠেন। তবে তৃতীয় লিঙ্গের অন্যদের মতো বাকীকে কখনো রাস্তায় নামতে হয়নি।
স্টাফ কোয়ার্টারে থাকা অবস্থাতেই নিজেকে অন্যভাবে পরিচিত করার ইচ্ছা ছিল বাকীর। সেই ইচ্ছা থেকেই হয়ে ওঠেন উদ্যোক্তা। শুরু করেন খাবারের ব্যবসা। আর খাবারের হোটেল দিয়েই দেখা পান সফলতার। এখন তৃতীয় লিঙ্গের অন্যদের চোখে বাকী হয়েছেন উঠেছেন অনুপ্রেরণা আর অনুকরণীয়।
বিজ্ঞাপন
তৃতীয় লিঙ্গের আবদুর রহমান বাকী রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। পীরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গঙ্গারাম গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের ছেলে তিনি। পিতৃহারা পরিবারের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বাকী সবার বড়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে একসময় পরিবার ছাড়েন। কিন্তু নিজ যোগ্যতায় সেই পরিবারকেই ভরণপোষণ দিয়ে যাচ্ছেন বাকী।
‘হিজড়া’ শব্দের বেড়াজালে থাকা অবহেলিত বাকী অন্যদের মতো নন। কিছু করার সুযোগ না পেয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ যখন মানুষকে জিম্মি করে উপার্জনের পথ খোঁজেন, সেখানে বাকী একটু ভিন্ন। তার চিন্তা, কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। কাউকে জিম্মি করে টাকা নেওয়াটা যে দৃষ্টিকটু, এই তাড়নাই তাকে উদ্ভাবনী কাজ খুঁজতে বাধ্য করে।
একসময় নিজের গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান রংপুর শহরে। কাজ পান পীরগঞ্জ সদর উপজেলা সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে, ঝাড়ুদার হিসেবে। তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সরকারি কর্মকর্তারা তাকে দিয়ে রান্নার কাজও করান। এভাবেই সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে ১৮টি বছর কাটে বাকীর। ওই সময়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে ওঠেন তিনি।
তবু তার মধ্যেও ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা জাগে। সেই ইচ্ছা থেকেই বাকী পীরগঞ্জ কলেজ রোডে শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। হোটেলের নাম দিয়েছেন ‘আদর-সোহাগ হোটেল’। সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে চারজনের। প্রতিদিন তাদের ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে হাজিরা দেন। আট বছর ধরে চলা সেই হোটেলের খাবার ও সেবায় স্থানীয়রাও মুগ্ধ।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী বাকী এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কাছে আইডল। কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করা বাকী এরই মধ্যে জমিও কিনেছেন গ্রামে। নিজের উপার্জিত টাকায় বিয়ে দিয়েছেন ছোট ভাই-বোনদের।
পীরগঞ্জের কলেজ রোডে কবি হেয়াত মামুদ কিন্ডারগার্টেনের সামনে আদর-সোহাগ হোটলে ঢাকা পোস্টের কথা হয় আবদুর রহমান বাকীর সঙ্গে। ৫০ বছর বয়সী বাকী জানান, সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে কাজ করার সময় কর্মকর্তাদের কাপড় ধোয়ার কাজ করে দিতেন। কর্মকর্তারা খুশি হয়ে মাঝেমধ্যে দু-এক শ টাকা দিতেন। সামান্য বেতনের সঙ্গে এই বকশিশ দিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হতো তাকে। এর মধ্যেও সময় পেলে প্রায়ই ছুটে যেতেন মঞ্চে।
বাকী বলেন, আবদুর রহমান বাকী থেকে জান্নাতুল বাকী হয়েছি। পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। তবু আমি পরিবার ও সমাজের বোঝা হইনি। জীবনের জন্য সংগ্রাম করেছি। সামান্য বেতনে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে কাজ করে নিজেকে বদলেছি, সাহায্য করেছি পরিবার-পরিজনকেও। হিজড়াদের সবাই অবহেলা করলেও আমি চেষ্টা করেছি হিজড়াদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে। আমি অনেকটাই সফল। আমার মতো অন্য হিজড়ারাও যদি নিজেদের বদলানো চেষ্টা করে, তবে সফলতার পাশাপাশি হিজড়াদের সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ভাবনা আসবে।
বাকীর হোটেলে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড় থাকে। কারণ, তার সুস্বাদু রান্না জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সেখানে খাবার খেতে আসা স্থানীয় সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন এক বেলা হলেও এখানে আমি খেতে আসি। হোটেলের পরিবেশ ও রান্না মানসম্মত। এখানে পীরগঞ্জের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুপুরের খাবার খেতে আসেন। বাকীর আচরণ আর কঠোর পরিশ্রম সবার মন জয় করেছে। কেউ তাকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মনে করে না, বরং একজন সফল উদ্যোক্তা ও ভালো মানুষ হিসেবেই সবাই তাকে গ্রহণ করেছে।
এদিকে আবদুর রহমান বাকী ছাড়াও পীরগঞ্জে আরেক সফল উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন আরিফুল ইসলাম আরিফ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হয়েও অন্য সবার চোখে মানবিকতার অন্য রকম এক দৃষ্টান্ত ৩৩ বছরের এই যুবক। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তুলেছেন জেন্টস পার্লার ও চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। এই দুই প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত ১০০ জনকে নিয়মিত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাতা প্রদান করে আসছেন। পাশাপাশি এক বৃদ্ধাকে বসবাসের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন একচালা ঘরও।
অন্যদিকে মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী বালুয়া রোডে ফাস্টফুড ও রেস্টুরেন্টের দোকান দিয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের রতন মিয়া। নিজেকে সমাজের চোখে সাধারণ মানুষের মতো প্রতিষ্ঠিত করতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ডিগ্রি পাস করেছেন। এখন তার ফাস্টফুডের ব্যবসা ছাড়াও রয়েছে ভাড়ায় চালিত একটি গাড়ি। একসময় সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রতন এখন পরিবারেরও ভরসা। সমাজের মানুষের কাছেও নিজেকে পরিচিত করছেন জীবনযোদ্ধা হিসেবে।
তবে বাকী-রতনদের এই বদলের যাওয়ার পেছনে তাদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। রংপুর বিভাগ উন্নয়ন আন্দোলন পরিষদের আহ্বায়ক ওয়াদুদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি মিললেও বৈষম্য আর বিবর্ণ জীবনযাপন থেকে তাদের মুক্তি মেলেনি। বদলায়নি তাদের নিয়ে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকাংশ সদস্যই পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার। তবে এসব পাশ কাটিয়েও যে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তারা সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
তিনি আরও বলেন, এখন বাকী, রতনেরা সমাজের আর দশজনের মতোই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার সঙ্গে নিজেদের স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্যমতে, রংপুর জেলায় ৩৭০ জন তালিকাভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। যার অধিকাংশই বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছেন। তালিকাভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের ৩৭০ জনের মধ্য থেকে ১৮০ জনকে বিভিন্ন ট্রেডে (সেলাই, রান্না, কম্পিউটার, পারলার, মোবাইল-রেডিও-টেলিভিশন সার্ভিসিং) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এনএ