বিস্মৃতির আড়ালে ভাষা আন্দোলনে বরিশালের সমৃদ্ধ ইতিহাস
প্রাণ বির্সজন দিয়ে মাতৃভাষা অর্জনের পর কেটে গেছে ৭১ বছর। এই সংগ্রামে অসামান্য অবদান ছিল বরিশালবাসীর। কিন্তু সেই ইতিহাস জানেন না এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ। এমনকি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেও সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়নি। বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে খোদ বাংলা ভাষা। বরিশালের ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক স.ম ইমানুল হাকিম এবং কবি ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলা এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করা এবং ভাষা আন্দোলনে বরিশালের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়াকে ব্যর্থতা হিসেবে মনে করেন।
প্রফেসর স.ম ইমানুল হাকিম বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন বরিশালেও তীব্রতর ছিল। ঢাকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিছিল, সভা, হরতাল পালন করা হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, ভাষা আন্দোলনে বরিশালের যে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস তা আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি। এটি আমাদের চরম ব্যর্থতা।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনে বরিশাল অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল ছিল। আন্দোলনের প্রেরণাদানকারী অমর একুশের গানের রচয়িতা, দুইজন সুরকার সকলেই কিন্তু বরিশালের সন্তান। বরিশালেই সুর করা হয়েছিল সেই গানের। এই ইতিহাস আমরা তুলে ধরতে আজও পারছি না। এই ইতিহাস আলোচনায়ও আসে না। এমনকি আমরা অনেকেই ভাষা শহীদদের ভুলে গেছি। ভাষা শহীদদের প্রতি যদি আমরা সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জানাতে চাই তাহলে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন এবং একমুখী শিক্ষা চালু করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলা ভাষা হবে আমাদের শিক্ষার মাধ্যম। মাতৃভাষাকে যদি আমরা মর্যাদা না দিই, মাতৃভাষাকে যদি আমরা সুরক্ষা না করি তাহলে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ হবে না। আর এত বড় সংগ্রামের ইতিহাসের পর পাওয়া বাংলা ভাষাকে যদি আমরাই মর্যাদা দিতে না পারি তাহলে পৃথিবীতে নিজেদের আমরা গুরুত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপনও করতে পারব না।
স.ম ইমানুল হাকিম বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান করেছিলেন। বাঙালি সেটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিল। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাঙালি ছিলেন। অর্থাৎ বাঙালির মধেই কিন্তু ঘাপটি মেরে বসে থাকে অগ্রগতির বিপক্ষের লোকজন। মনে রাখতে হবে ভাষা আন্দোলন থেকেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত, ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল সেই সূত্র ধরেই কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আমরা পেয়েছি। বাস্তবতা হলো যে আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম হয়েছিল তা আজও অধরাই থেকে গেছে।
বিজ্ঞাপন
কবি ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ১৯৫২ সালে ঢাকায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তার প্রভাব বরিশালে ব্যাপকভাবে পড়েছিল। ঢাকার ঘটনার পরের দিন বরিশালে খবর পৌঁছালে অসংখ্য ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে মিছিল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে বরিশালে আন্দোলনের সেই প্রকট রূপটি সর্ম্পকে আমরা এখনো বিস্তৃতভাবে জানি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, ভাষা আন্দোলনের জন্য যে আমরা জীবন দিলাম এই জীবনদানের পরবর্তী প্রেক্ষিত কী?
বরিশালের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন নিয়ে আবদুল লতিফ প্রচুর গান লিখেছিলেন। তার লেখা, ‘ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি ওরে বাঙালি’ কিংবা ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গানগুলো তখন মানুষের মুখে মুখে গীত হত। সামগ্রিকভাবে আন্দোলনের সঙ্গে বরিশালের একটি নিবিড় সর্ম্পক রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে বরিশালের ভূমিকাও অনেক বড়। বরিশালের মানুষ সহজে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারত। এজন্য তারা অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার খবর জানতে পারত। যে কারণে বরিশালের মানুষ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র মত একটি গান লিখতে পেরেছে। এটি বরিশালবাসীর একটি বড় অবদান। বরিশালে আরও বহু কাজ হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে।
অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তী মনে করেন, ভাষা আন্দোলনে কোথায় কয়টি মিছিল হয়েছে সেই হিসেব অবিবেচক। মিছিল হচ্ছে পুরো আন্দোলনের একটি ছোট্ট সূচকমাত্র। বরিশালেও মিছিল হয়েছে, আবার সারা দেশেও হয়েছে। তবে ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিক প্রভাবের একটি বড় ফলাফল হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দেখছি সমস্ত বিষয়টি উল্টো দিকে ঘুরছে। ভাষা নিয়ে আমাদের যে আবেগ ও ভালোবাসা ছিল, যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাদের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকে জেনেছি, সেই প্রবীণ মানুষগুলো যা চেয়েছিলেন, ঘটলো তার উল্টো। আমাদের ভাষা এখন বাংলা। কেউ আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষার অর্ধেক আরবি ভাষা। আরেক ভাগ ইংরেজি মাধ্যম,
আরেক ভাগ বাংলা। তিন রকম শিক্ষার একটা জগাখিচুড়ি অবস্থায় বাংলার অবস্থান কোথায় তা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।
তিনি বলেন, বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দায়িত্ব ছিল বাংলা একাডেমির। বাংলা একাডেমির কথা ছিল পরিভাষা তৈরি করবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের জন্য বাংলায় বই তৈরি করবে। বাংলা মাধ্যমে সব পড়াশোনা হবে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলা একাডেমি এত বছরেও বাংলাকে সহজলভ্য করতে পারেনি। আমাদের থেকেও অনেক ছোট দেশেও মাতৃভাষায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুবিধা আছে। সব দেশেই শিক্ষা একমুখী। আমাদের মতো বহুমুখী না। বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধুমাত্র বৈষম্য তৈরি হয়।
দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, আমি মনে করি আমরা ক্রমাগত পেছনের দিকে যাচ্ছি। যদি একটি উদাহরণ দিই, সাইনবোর্ডের লেখা কোথাও সরাসরি ইংরেজিতে, আবার কোথাও বাংলা অক্ষরে ইংরেজি লেখা। ঢাকা শহরে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অথচ এই শহরেই বেশি তদারকি করার কথা ছিল। আমরা ভাষা নিয়ে কথা বলছি, আন্দোলন বা ১৯৫২ সালের স্মৃতিচারণ করছি, উর্দুর প্রস্তাবে ১৯৪৮ সালে না না বলে প্রতিবাদ করেছি, সে কথাও বলছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলা থেকে আমরা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি। আগের মানুষ যতটা বাংলা লিখতে পারত, বলতে পারত, এখনকার মানুষ তা পারে না। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, শিক্ষিত মানুষের দায়িত্ব এই জায়গায় ফিরে আসা।
প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ২৮ সদস্যের মধ্যে ৫ জনের বাড়ি ছিল বরিশাল অঞ্চলে। এর মধ্যে রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার কসবা গ্রামে। পাশাপাশি আরও ৪টি পদে ছিলেন শামসুল আলম, শামসুল হক চৌধুরী, আখতার উদ্দিন আহমেদ এবং মুহাম্মদ মুজিবুল হক। যাদের সকলের বাড়িই বরিশাল বিভাগে। অথচ ভাষা সংগ্রামীদের কোনো চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফকির বাড়ি রোডস্থ তার দুইতলা টিনের ঘরের দোতলায় বসে সুর দেন। সেই ঘরটি অবিকল এখনো রয়েছে। কিন্তু ৭১ বছরেও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা।
এমজেইউ