উচ্চারণে আটকে যায় মায়ের ভাষা
‘মায়ের মুহেত্তে হুইন্না হুইন্না আমরা কতা কওয়া হিকছি। আমরাতো বই পত্তরের গুছাইন্না কতা জানি না। শহরো থাহে আমার নাতিরা, হেরা আমার কতা কয়ডা বুঝে কয়ডা বুঝে না। আমিও তাগর বাংলা ইংরেজি মিশাইন্না কতা কম কম বুঝি।’
আক্ষেপের সুরে এভাবেই বলছিলেন ময়মনসিংহের কল্পা এলাকার নুরজাহান বেগম (৬৫)। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ভাষাও। গ্রামবাংলার আঞ্চলিকতা হারিয়ে নতুন প্রজন্মের মুখে মুখে বই পুস্তকের ভাষা।
বিজ্ঞাপন
ময়মনসিংহ নগরের বেসরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ফাতীন ঈশ্বরাক সানাক। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপারে। তার উত্তরটা ছিল এমন, ‘আমি ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা জানি না, শিখিওনি। আমার বাবা-মা যেভাবে কথা বলে আমিও তাই শিখেছি। আমার আত্মীয়স্বজনরা কিংবা স্কুলে আমার বন্ধুরা, শিক্ষক, সবাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। আমি তো কারো মুখে আঞ্চলিক ভাষা শুনিনি। তাই পারি না।
শুধু সানাকই নয়, এমন অবস্থা বেশিরভাগ শহুরে শিশু-কিশোরদের। শুদ্ধ প্রমিত বাংলায় ছেলেমেয়েরা কথা বলবে এমনটাই চাওয়া শহুরের প্রায় সকল বাবা-মার। সন্তানের কথায় যাতে আঞ্চলিকতা না ঢুকে সেজন্য ঘরের কাজের লোকের মুখ থেকেও মুছে দেয় আঞ্চলিকতা। কিন্তু বাঙালির মনে-মগজে আছে শেকড়ের টান, আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার বাসনা।
বিজ্ঞাপন
সেটির প্রমাণও মিলল নগরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে একদল যুবকের আড্ডায়। নিজেদের আড্ডায় তারা ধরে রেখেছেন আঞ্চলিকতা। মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক যুবকের ভাষ্য, ‘পড়ালেহার দরহারে কিংবা অফিস আদালতো চাকরি বাকরির লাইগ্গা আমরা দাপ্তরিক ভাষা অর্থাৎ শুদ্ধ ভাষাডা ব্যবহার করি। কিন্তু আরাম পাই আমরা ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় রাও কইয়াই। বাসাত কিংবা বন্ধুগর আড্ডাত মন খুইল্লা নিজেগর লাহান রাও করলে শান্তি পাই। নিজের ভাষাডাত যে শান্তিডা আছে এইডা অন্য কোনো ভাষাত নাই।’
গবেষকদের মতে, আঞ্চলিকতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রভাব রাখতেই হবে। একইসঙ্গে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার আর চর্চা সম্পর্কে সচেতনতাও খুব জরুরি।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক স্বপন ধর বলেন, আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ বুঝলেও অন্য অঞ্চলের মানুষ বুঝে না। সিলেট-চট্টগ্রামের ভাষা যেমন আমরা বুঝি না, আমাদের ভাষাও তারা বুঝে না। উপভাষার এই যে একটা সমস্যা, এই সমস্যার কারণেই বাধ্য হয়ে আমাদের প্রমিত ভাষার আশ্রয় নিতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের যে ভাষাগুলো রয়েছে সেটি যদি আমরা সংরক্ষণ করতে না পারি, বলতে না পারি সেক্ষেত্রে আমাদের অতীত যে ঐতিহ্য রয়েছে তা মাঠে মারা যাবে।
তিনি আরও বলেন, ভাষাকে জাদুঘরে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না। রক্ষা করার জন্য আমাদের চর্চায় রাখতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে রক্ষার জন্য আমাদের তেমন কোনো চেষ্টা নেই। সেভাবে এগিয়ে আসছে না কেউ। পৃথিবীর সব দেশেই উপভাষা সংরক্ষণে কাজ চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে যেটুকু আছে সেটা যথেষ্ট নয়। এর জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে হবে। ৩০ মাইল অন্তর অন্তর উপভাষার মর্যাদা দিয়ে সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর পাশাপাশি আমাদের প্রমিত ভাষার দিকে এগিয়ে যেতে হবে সমান্তরালভাবে। একটিকে মাটি চাপা দিয়ে আরেকটিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাহলে আমাদের সমস্ত ঐতিহ্য ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
বাংলা ভাষা হচ্ছে আমাদের প্রাণ। আর যার যার আঞ্চলিকতা হলো মায়ের ভাষা। যে ভাষায় আমাদের পিপাসা মিটে। এই ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও চর্চা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে সংরক্ষণেরও।
এমজেইউ