সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ঘাগটিয়া গ্রাম। এ গ্রামে বছরের প্রত্যেকটা দিনই যেন বইমেলা। এই গ্রামের মানুষের মেলায় গিয়ে বই কিনে আনতে হয় না। প্রতিদিন গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে বই বিলি করেন একদল শিক্ষার্থী। বই পড়া শেষ হলে আবার সেই বই নিয়েও আসেন। নিজেরা বই পড়ার পাশাপাশি গ্রামের মানুষকে বই পড়ায় অভ্যস্ত করে তুলছেন উদ্যমী এই তরুণরা। 

জ্ঞানের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে গড়ে তুলেছেন ঘাগটিয়া গণগ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে এখন প্রতিদিন বই পড়তে আসেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। গ্রামের স্কুল ও কলেজপড়ুয়াদের এখন সময় কাটে পাঠাগারে বই পড়ে, সাহিত্যের আড্ডায়। তরুণদের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করছে গ্রামবাসী। 

পাঠাগারের নামে স্থানীয় বাজারে নিজের জায়গা দান করেছেন শিক্ষানুরাগী তোয়াজ আলী। সেই জায়গায় ২০২০ সালে সরকারের তৎকালীন যুগ্ম সচিব এনামুল হাবীবের সহযোগিতায় নির্মাণ হয়েছে পাঠাগারের পাকা স্থায়ী ঘর। যেখানে এখন প্রায় ২ হাজার বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন পাঠকরা। করোনাকালের অবসর সময়কে কাজে লাগাতে ‘জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক আগামী প্রজন্ম’ স্লোগানে ২০২০ সালের ৩ আগস্ট উদ্বোধন হয় জ্ঞানের এই আলোঘরের।

গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থী নাসরুল হাসান বলেন, আমরা বন্ধু-বান্ধব মিলে এসএসসির পর বেকার সময় কাটাতে এই পাঠাগার গড়ে তুলি। প্রতিদিন আমাদের বই পড়ার কার্যক্রম চলে। 

শিক্ষার্থী নাবিল বলেন, পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা প্রতিদিন গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে বই দিয়ে আসি। এক সপ্তাহ পর পড়া শেষ হলে সেই বই নিয়েও আসি। এখন আমাদের গ্রামে প্রায় ৫০০ পাঠক আছেন। বই সংকটের কারণে আমরা পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। 

বই বিলির গল্পটা শুরু হয় করোনাকাল থেকে। করোনাকালে অবসর সময়ে ঘরে বসে বসে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল নতুন প্রজন্ম। এভাবে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে যাওয়া থেকে কীভাবে সমাজকে পরিবর্তন করা যায় তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে যায় একদল তরুণ। তাদের এই চিন্তাভাবনা থেকে জন্ম হয় একটি পাঠাগারের। পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে তরুণ উদ্যোক্তাসহ পুরো গ্রামবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা বুলবুল আহমদে বলেন, আমাদের এই ছেলেরা জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। তারা প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো ফেরি করে বেড়াচ্ছে। 

ঘাঘটিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মীম সাইফুর বলেন, আমরা হাওরপাড়ের মানুষ। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকি। আমরা বই পড়ার সঙ্গে এতটা অভ্যস্ত না। তবে এই গণগ্রন্থাগারের কারণে আমরা বই পড়তে অভ্যস্ত হয়েছি। 

ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাঠাগারের উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পরিষদের সবাই শিক্ষার্থী হওয়ায়  উদ্বোধনের পর থেকেই নানা সংকট রয়েছে পাঠাগারটিতে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে বইয়ের। বইয়ের অভাবে খালি পড়ে রয়েছে বুক সেলফ। এছাড়াও বই বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ভ্যান, তথ্য লিপিবদ্ধের জন্য একটি কম্পিউটার ও নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা প্রয়োজন। এসব সংকট নিরসনে সরকারি সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। 

পাঠাগার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী অমিও হাসান বলেন, করোনাকালে শিক্ষার্থীরা মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এটি রোধ করতে ঘাঘটিয়া গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলি। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে এসে বই পড়ে। আমরাও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসি পড়ার জন্য। 

পাঠাগার পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বই সংকটসহ আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। এখন বাড়ি বাড়ি বই দেওয়ার জন্য একটি ভ্যানের প্রয়োজন। পাশাপাশি একটি কম্পিউটার, নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা থাকলে পাঠাগারটি আরও সুন্দর হতো। 

এদিকে সংকটের বিষয়ে পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে অফিসে যেতে বলেছেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা।

জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় যদি গন্থাগার থাকে তাহলে আগামী প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে সরে আসবে এবং সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করবে। গন্থাগারের বই সংকট কাটানোর চেষ্টা করবেন বলে তিনি জানান। 

সোহানুর রহমান সোহান/আরএআর