ফজরের আজানের সময় ঘুম ভাঙে আয়েশা, সুফিয়া, কদবানু, সেফালীসহ অগণিত শ্রমজীবী নারীর। স্বামী-সন্তানদের জন্য রান্নাবান্না, ঘর-উঠোন পরিষ্কার করতে করতেই জেগে ওঠে ভোরের রুপালি সূর্য। এরই মধ্যে সংসারজীবনের হাল ধরতে জীবিকার অন্বেষণে তাদের বের হতে হয় কাকডাকা ভোরে।

প্রতিদিন সকাল ৭টা বাজলেই খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। কেউ যান পাথরের কাজে, কেউ চা বাগানে, আবার কেউ কৃষি কাজে। সকাল-সন্ধ্যা পুরুষদের সমতালে কাজ করলেও দিনশেষে থাকে মজুরি বৈষম্য। এই বৈষম্য নিয়েই প্রতিদিন চলে জীবিকার যুদ্ধ, সন্তানদের মানুষ গড়ার স্বপ্ন। এই চিত্র দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার। তারা এই বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে পুরুষদের সঙ্গে কাজ করে গড়তে চান আধুনিক উন্নত দেশ ও সুন্দর পৃথিবী।

জীবন সংগ্রামী আয়েশা, আফরোজা ও শিউলি বেগম বলেন, আমাদের কোনো ‘দিবস-টিবস’ নেই, প্রতিদিনই সমান। কে ভাবে আমাদের কথা। একদিকে মজুরি কম, আরেক দিকে সবকিছুর দাম বেশি। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। তারপরও দিনশেষে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখি। তারা যেন ভালো থাকে, পড়াশোনা করে অনেক বড় হয়

পাথর ও সমতলের চা শিল্প সমৃদ্ধ জেলা পঞ্চগড়। এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞে নারী শ্রমিকের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ। অভাব-অনটন ও পরিবারের হাল ধরতে বাধ্য হন নারীরা। কারও দরিদ্র সংসার, কেউ বিধবা, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা আবার কেউ অবিবাহিতা। স্থানীয় নারী শ্রমিকের পাশাপাশি পরিবারের ঘানি টানতে জেলার বাইরে নীলফামারী, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও থেকেও হাজার হাজার নারী যুক্ত রয়েছেন এখানকার বিভিন্ন কাজে।

জেলার জগদল, ভজনপুর, বুড়াবুড়ি, শালবাহান, তেঁতুলিয়া সদর, বাংলাবান্ধা, সিপাইপাড়া, তিরনইহাট, রনচন্ডীর বিভিন্ন পয়েন্টে পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার নারী। তারা পুরুষদের সঙ্গে পাথর তোলা, চালুনি, নেটিং, ভাঙা, লোড-আনলোড ও আনা-নেওয়ার কাজ করছেন। শ্রেণি ও মজুরি বৈষম্য থাকলেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

কথা হয় জীবন সংগ্রামী আয়েশা, আফরোজা ও শিউলি বেগমের সঙ্গে। তারা বলেন, আমাদের কোনো ‘দিবস-টিবস’ নেই, প্রতিদিনই সমান। কে ভাবে আমাদের কথা। একদিকে মজুরি কম, আরেক দিকে সবকিছুর দাম বেশি। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। তারপরও দিনশেষে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখি। তারা যেন ভালো থাকে, পড়াশোনা করে অনেক বড় হয়।

পাথর ক্র্যাশিং মেশিনে কাজ করা অবস্থায় কথা বলেন রাশিদা খাতুন। বলেন, খুব অভাবের সংসার। ঘরে এক ছেলে, দুই মেয়ে। স্বামী আরেকটা বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। উপায়ন্তর না দেখে পাথরের সাইটে এসে কাজ বেছে নিয়েছি। এই শ্রমের উপর ভর করেই চলছে পরিবার।

এরকম গল্প অনেকের মুখে। কারও স্বামী থাকতেও নেই, স্বামী আরেক বিয়ে করে বিপদের মুখে ফেলে গেছে, কেউ বিধবা হওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। আবার কারও যৌতুকের জন্য বিয়ে হচ্ছে না। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে আঁচলে আসে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। মেশিন বন্ধ থাকলে থাকে না কাজ, বন্ধ হয়ে যায় জীবিকা।

এদিকে ধুলাবালিতে কাজ করতে গিয়ে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন নারী শ্রমিকরা। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাণঘাতী ব্যাধি সিলিকোসিস রোগে আক্রান্তের আশঙ্কায় রয়েছেন এসব শ্রমিক। ক্র্যাশিং মেশিনের উচ্চ শব্দ, মেশিনের ভাঙা পাথরের উৎপন্ন ধুলাবালি নাক-মুখে প্রবেশ করে। এতে শ্বাসকষ্ট, সর্দি-জ্বরসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। কারো শরীরে বাসা বেঁধেছে ফুসফুস, চর্মরোগ। দেখা দিচ্ছে চোখের সমস্যাও।

কারও স্বামী থাকতেও নেই, স্বামী আরেক বিয়ে করে বিপদের মুখে ফেলে গেছে, কেউ বিধবা হওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। আবার কারও যৌতুকের জন্য বিয়ে হচ্ছে না। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে আঁচলে আসে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। মেশিন বন্ধ থাকলে থাকে না কাজ, বন্ধ হয়ে যায় জীবিকা

নারীরা জানান, সারাদিন ধুলাবালিতে কাজ করার পর সন্ধ্যায় বাড়িতে গেলে প্রচণ্ড শরীর ব্যথা হয়, চোখে কম দেখেন, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শুকনা কাশি, মাথা ঘোরা আর জ্বর হয় মাঝে মাঝে। আর খাওয়াতেও রুচি থাকে না। কিন্তু কি আর করার, পেটের তাগিদে কাজ করতে হয়।

বাংলাবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান কুদরত-ই খুদা মিলন বলেন, পাথর সমৃদ্ধ এই এলাকায় হাজার হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এই পাথরেই ঘোরে তাদের ভাগ্যের চাকা। এখানে কাজ করে তারা সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেন। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি এসব নারী শ্রমিকের পাশে দাঁড়াতে। তারা যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। জেলা প্রশাসনসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমেও ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করছি। বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছি। সামনে আরও পরিকল্পনা রয়েছে।

এস কে দোয়েল/এমজেইউ