‘আগে মুরগির দামডা কম আছিল। প্রতি সপ্তাহে কিইন্যা খাইবার পাইছি। অহন তো দাম খালি বাইড়াই যাইতাছে। চাল কিনলে মুরগি কিনবার পাই না, মুরগি কিনলে চাল কিনবার পাই না। পুলাপান তো হেইডা বুঝে না। শুক্রবার আইলে হেরা মুরগির মাংস খাইতে চায় কিন্তু এহন তো কিনার ক্ষমতা নাই। মাসেও একবার কিনবার পারি না।’

এভাবেই আক্ষেপ করে বলছিলেন ময়মনসিংহ নগরীর সানকিপাড়া বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা দিনমজুর দীন ইসলাম। শুধু দীন ইসলাম নয়, মুরগির দাম বাড়ায় এরকম অবস্থা তার মতো প্রায় প্রতিটি স্বল্প আয়ের মানুষের। এমনকি হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদেরও।

মুরগির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাম জিজ্ঞাসা করছিলেন আফজালুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। দোকানদার দাম বলতেই কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘এত্ত দাম বাড়ছে!’ বলেই চলে যাচ্ছিলেন সেখান থেকে। এ সময় মুখোমুখি হন ঢাকা পোস্টের।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আফজালুর রহমান। তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। যেখানে উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি তিনি। সংসারের ব্যয় আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন সাধ আর সাধ্য মেলাতে পারেন না। যা বেতন পান তার অধিকাংশই বাসাভাড়া আর চাল-ডালে চলে যায়। এরপর কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস কেনার মতো টাকা তেমন আর হাতে থাকে না। অনেকদিন ধরেই গরুর মাংস আর ভালো মাছ কেনা বাদ দিয়েছেন। তবুও আগে ব্রয়লার মুরগি দিয়ে মোটামুটি আমিষের চাহিদা মেটাতেন। কিন্তু এখন তারও যে দাম বেড়েছে, কেনার আর উপায় নেই।

অনেকটা হতাশা নিয়েই আফজালুর রহমান বলেন, জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে তো আমাদের আয় বাড়েনি। সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে। শুধু একটি জিনিসের দামই কম ছিল, ব্রয়লার মুরগি। কিন্তু এখন এটাও যে মানুষ খাবে তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। চাল-ডাল কিনেই তো সব টাকা শেষ, মাংসের চাহিদা মেটাবে কোথা থেকে! এমন একটা পর্যায়ে আছি, মনে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বাঁচার আর কোনো রাস্তা নেই। অনেকটা না খেয়ে মরার অবস্থা।

সোমবার (৬ মার্চ) নগরীর সানকিপাড়া, মেছুয়া বাজার, মিন্টু কলেজস্থ কাঁচাবাজার, নতুনবাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২৪০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা। দুই দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা কমে। বিক্রেতাদের দাবি, খামার থেকে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার কারণেই বেশি দামে মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে অর্ধেকে নেমে এসেছে বিক্রি। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারাও।

সজীব ব্রয়লার হাউসের মালিক সজীব ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগেও ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেছি ১২০ টাকা কেজি। সেটি এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আগে একজন রিকশাওয়ালাও চাইলে সহজে একটি মুরগি কিনে খেতে পারতেন। মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা নিয়মিত মুরগি নিতেন, কিন্তু এখন দেখা যায় তারা মুরগি না কিনে প্রায়ই শুঁটকি কিনে খাচ্ছেন। আগে যেখানে দৈনিক ২০০ কেজির উপরে মুরগি বিক্রি করতাম এখন ১০০ কেজিও বিক্রি হয় না। বিক্রি কমায় আমাদের লাভও কমে গেছে। বলা যায় অনেকটা লোকসানই হচ্ছে।

অন্যদিকে খামারিরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে পোলট্রি ফিড ও ওষুধের দাম বাড়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন তারা। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলায় পোলট্রি খামারি রয়েছেন ১১ হাজার ৬০৯ জন। যেখানে ফুলবাড়িয়া উপজেলাতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫ হাজার ১২০ জন পোলট্রি খামারি মুরগি পালন করছেন। এই উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের কান্দানিয়া ফরিদের পাড় গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা সজীব ইসলামের মতো অনেক খামারিই মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধিতে হতাশ। চলতি সপ্তাহেই ৫০ কেজি ফিডের বস্তাতে দাম বেড়েছে ২০০ টাকা।

খামারি সজীব মিয়া বলেন, কয়েক মাস আগেও ৫০ কেজি ফিডের বস্তা কিনেছি ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। এখন তা কিনতে হচ্ছে ৩ হাজার ৭৫০ টাকায়। ধারাবাহিকভাবেই ফিড মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে যদি দাম বাড়তেই থাকে তাহলে আমাদের খামার করা বাদ দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, মুরগির দাম বাড়াটাই মানুষ দেখছে কিন্তু খাবারের দাম যে ক্রমান্বয়ে বাড়াচ্ছে সেটা কেউ দেখে না। সেটা তদারকি কেউ করে না।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমারী খাতুন বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে ফিডের দাম বেড়েছে। ইউক্রেন থেকে প্রচুর খাদ্য উপকরণ আসত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা) বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সাপ্লাই কমে যাওয়ায় ডিমান্ড বেড়ে গেছে। ফলে দামও বেড়ে গেছে। এতে খামারিদের বাধ্য হয়েই দাম বাড়াতে হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কী পরিমাণ খামার বন্ধ হয়ে গেছে, এই পরিসংখ্যান জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এই পরিসংখ্যান দিতে পারছি না। এটি প্রস্তুত করতে সময় লাগবে। সপ্তাহখানেক পরে জানাতে পারব।

করপোরেশন সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা মুখে শুনছি সিন্ডিকেট আছে কিন্তু আসলেই সিন্ডিকেট আছে কি না এটা মনিটরিং করে দেখা উচিত।

কারা মনিটরিং করবে এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, এটা সরকার থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নিশাত মেহের বলেন, আমরা মুরগির বাজার তদারকি করছি। আর কোম্পানি সিন্ডিকেটের ব্যাপারে জাতীয়ভাবে যে মনিটরিং করা হয় সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে স্থানীয়ভাবে যতটুকু মনিটরিং করা যায় ততটুকু করছি।

এমজেইউ