পটুয়াখালীসহ সারা দেশের হাটবাজারে এখন দেখা মিলছে তরমুজের। মৌসুমী ফল হওয়ায় বাজারে ক্রেতারা বেশি দামে কিনছেন। তবে বাজারে দাম অনেক বেশি হলেও কৃষকরা এই লাভ পাচ্ছেন না। কারণ প্রান্তিক কৃষকদের তরমুজ উৎপাদনে ও পাইকারদের কাছে তরমুজ পৌঁছে দিতে খরচ পড়ে যায় অনেক বেশি। এদিকে লাভবান হচ্ছেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

প্রান্তিক কৃষকরা স্থানীয় মহাজন ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে তরমুজ চাষ করে থাকেন। বাজারে ভালো দামে তরমুজ বিক্রি করতে না পারলে নিজের জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হয় তাদের। শ্রমিক ও পরিবহন খরচ মিটাতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, আবার সঠিক সময় বাজার না ধরতে পারলে কম টাকায় বিক্রি করতে হয়। এদিকে পাইকার ও বেপারীরা তরমুজ কেনার চেয়ে পরিবহন খরচ বেশি হয় বলে জানান।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বড় চাষিরা তরমুজ ফল উঠানোর সময় মাঠ থেকে গাড়িতে উঠাতে শ্রমিকদের প্রতি তরমুজ প্রতি এক টাকা ৫০ পয়সা টাকা করে খরচ হয়। এরপর স্থানীয় বাজারে নিতে হয় ট্রলিতে করে সেখানে প্রতি তরমুজ ৪ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়। এরপর ট্রলারে করে বাজারে নেওয়ার জন্য ট্রলার ভাড়া করতে হয় সেখানে ২০ থেকে ২৫ টাকা লাগে, এরপর ট্রলারে লোড করার সময় শ্রমিকদের ২ টাকা  দিতে হয়। আবার ট্রলার থেকে তরমুজ পাইকারদের দোকান অথবা গাড়িতে উঠাতে এক টাকা ৫০ পয়সা করে শ্রমিকদের খরচ দিতে হয়। এরপরে ঢাকা অথবা উত্তর অঞ্চলের যে কোন জায়গায় নিতে একটি মাঝারি সাইজের ট্রাক ভাড়া করতে হয়। ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায় ভাড়ায় চলে যায়। এরপরে বাজার যদি ভালো না পাওয়া যায় তাহলে কম দামে তরমুজ বিক্রি করে লসের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয় অনেককে।

 

আবার প্রান্তিক চাষিরা তাদের নিজ মাঠ থেকে তরমুজ বেপারি বা পাইকারদের কাছে সরাসরি বিক্রি করে দেয়। এতে করে তরমুজ খুব কম মূল্যে বিক্রয় করতে হয় প্রান্তিক চাষিদের। এদিকে মাঝারি সাইজের চাষিরা মাঠ থেকে তরমুজ তুলে নিয়ে স্থানীয় বাজারে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। সেখানেও বেপারী ও পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণে কম মূল্যে বিক্রয় করতে হয়। এতে করে কৃষকদের পরিশ্রমের লাভের অংশ চলে যায় পাইকার ও বেপারীদের কাছে।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি বছর ২৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর নতুন করে অনেকে জমি প্রস্তুত করছেন তরমুজ চাষিরা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডিসেম্বর থেকেই তরমুজের চাষ শুরু করেন কৃষকেরা। গত বছর ১৩০০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হলেও এই মৌসুমে আবহাওয়া ভালো থাকলে ২ হাজার কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

ক্রেতা মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, তরমুজ কেনার জন্য বাজারে এসেছি, কিন্তু তরমুজের দাম বেশি চাচ্ছে। ৪০ টাকা কেজি মূল্যে তরমুজ বিক্রি করে অথচ পিস হিসাবে তরমুজ কিনলে একটি তরমুজ ১৫০ টাকার নিচে কেনা যায় না। রমজান মাস তাই বেশি দাম হলেও তরমুজ কিনতে হচ্ছে।

ক্রেতা শাহাবুদ্দিন বলেন, বর্তমানে তরমুজের দাম আগের চেয়ে অনেক বেশি, বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। আমাদের তো কিছু করার নেই, দাম একটু বাড়তি হলেও পবিত্র রমজানে ইফতারির জন্য তরমুজ কিনে খেতে হয়।

হেতালিয়া বাধঘাট এলাকার বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, তরমুজ কিনে নিয়ে এসেছি ২ লাখ টাকার। কাস্টমারের অভাবের কারণে প্রায় এক লাখ টাকার তরমুজ পচে গেছে। বাকি তরমুজ এখন বাজারে বিক্রি করছে। তরমুজের দাম কম কিন্তু কাস্টমার নেই।

চর মোন্তাজ এলাকার কৃষক আব্দুল মজিদ হাওলাদার বলেন, খেত থেকে উঠানোর সময় শ্রমিকদের টাকা দিতে হয়, তারপর ট্রলি ভাড়া, ঘাট ভাড়া, ট্রলার ভাড়া আবার ঘাট ভাড়া, এরপর ট্রাক ভাড়া। কৃষকদের উৎপাদন থেকে শুরু করে সব জায়গায় প্রচুর টাকা খরচ হয় আবার যখন বিক্রয় করতে যাই তখন বাজারে আমরা মূল্য পাই না। এতে করে আমরা কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হই।

চর শিবা এলাকার কৃষক জলিল প্যাদা বলেন, আমরা তরমুজ দিয়েছি লাভের আশায় এবং বিভিন্ন খরচ অনেক বেড়ে গেছে, বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, এতে করে যেই মূল্য পাওয়ার কথা সেই পরিমাণ মূল্য পাইনি। বিভিন্ন পরিবহন খরচে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এ বছর ছয় একর জমিতে ৬ লাখ টাকা খরচ করেছি। তবে এ বছর অর্ধেক টাকায়ও বিক্রি করতে পারব না। বিভিন্ন শ্রমিকদের খাটিয়ে সে মূল্য আসে না।

কুড়িগ্রাম জেলার বেপারী লোকমান মৃধা বলেন, আমি গত তিনদিন ধরে পটুয়াখালীর গলাচিপায় তরমুজ কেনার জন্য এসেছি। ইতোমধ্যে ট্রাক ধরে তরমুজ কুড়িগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। এ বছর আবহাওয়ার কারণে তরমুজের সাইজ খুবই ছোট আবার তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবহন খরচ অনেক বেশি হয়ে গেছে। এজন্য আমাদের তরমুজ কেনার চেয়ে পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, তরমুজ চাষে সাধারণত বড় চাষি, মাঝারি চাষি ও প্রান্তিক চাষি হয়ে থাকে। এখানে যার যার সামর্থ্য অনুসারে চাষ করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রান্তিক চাষিরা ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে দরদাম করে তরমুজ কেনে। সড়কপথে তরমুজ নিতে খরচ বেশি বলে তারা কৃষকদের দাম কম দিচ্ছে। এতে করে প্রান্তিক কৃষকরা দাম কম পাচ্ছে। আমাদের পরামর্শ থাকবে পাইকাররা যেন সিন্ডিকেট করতে না পারে। আমরা অত্যন্ত সজাগ রয়েছি যে কোনো বিষয়ে আমরা কৃষকদের পাশে রয়েছি।

মাহমুদ হাসান রায়হান/আরকে