‘বন্ধুরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিল আমি তখন বাড়িতে বসেছিলাম’
‘২০২০ সালের ক্লাস এইটে আমি অটোপাস করি। সেসময় আমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য হেড স্যারকে টাকা দিয়েছি কিন্তু টাকার রশিদ পাইনি। গত ছয় মাস আগে জানতে পারি যে আমার রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এরপর থেকেই স্যারকে বলতেছি দেখেন বিষয়টা, রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন আমি পরীক্ষা দিতে চাই। এটা আমার জীবনের বিষয়। স্যার বলেছিল বাবা তুমি কোনো টেনশন করো না এটা হবেই। আমি চেষ্টা করতেছি তুমি তোমার মতো পড়াশোনা করো। এখন শেষ সময়ে এসে আমি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। বন্ধুরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিল আমি তখন বাড়িতে বসেছিলাম। আমার যে কি কষ্টটা লাগতেছে সেটা আমি বুঝতেছি।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারী সদর উপজেলার টুপামারী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান আশিক। রোববার (৩০ এপ্রিল) শুরু হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা ছিল তার। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ভুলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি আশিক। এরআগে শনিবার সারাদিন প্রবেশপত্রের জন্য অপেক্ষা করেও না পেয়ে রাতে সড়ক অবরোধ করে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পরে গভীর রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন নাহার তাদের বাড়িতে প্রবেশপত্র পৌঁছে দেওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৫ শিক্ষার্থী। তবে রেজিস্ট্রেশন না হওয়ায় আশিকসহ তিন শিক্ষার্থী প্রবেশপত্র পায়নি।
বিজ্ঞাপন
নীলফামারী সদর উপজেলার টুপামারী দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা ছিল ৪৯ জনের। তবে শনিবার পর্যন্ত ১৮ জন পরীক্ষার্থী প্রবেশ পত্র না পেলে সকাল থেকে স্কুলের বারান্দায় অবস্থান করেন ১৬ শিক্ষার্থী। সকাল পেরিয়ে রাত হলেও পরীক্ষার প্রবেশ পত্র না পাওয়ায় রাস্তা অবরোধ করেন তারা। রাস্তা অবরোধের সময় ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবক ও তাদের সহপাঠীরা।
আশিক বলেন, গত ১৫ দিন আগে স্যার বলতেছে আমি যে রেজিস্ট্রেশন করছি তার প্রমাণ দাও। আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। আমার কাছ থেকে যে উনি টাকা নিয়েছে তখন তিনি কোনো রসিদ দেননি আমায়। আমার সঙ্গে আরও দুই বন্ধুর সমস্যা হয়েছে। তাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল কিন্ত পরীক্ষা দিতে না পেরে আমার মতো বাড়িতে অসহায় হয়ে বসে আছে। আমি এটার সুষ্ঠু বিচার চাই। দুই বছর যাবত যে আমি স্কুলে পড়লাম। স্যার তখন বলল আমার এটা হবে টেনশন করা লাগবে না। এখন শেষ সময়ে বলতেছে আমি সমাধান দিতে পারলাম না। আমি চাই এই স্যার যেন স্কুলে আর থাকতে না পারে প্রশাসন যেন সেরকম ব্যবস্থা নেয়। আমার আজকে সমস্যা হয়েছে কাল স্কুলের ছোট ভাই-বোনদের হবে। তাদের সঙ্গেও এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। এরকম ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য এই স্যারের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
বিজ্ঞাপন
আশিকের বাবা রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে ক্লাস সিক্স থেকে ওই স্কুলে পড়ছে। ক্লাস এইটে উঠে রেজিস্ট্রেশনও করল কিন্তু সেটা নাকি হয়নি। কেন হলো না জানতে চাইলে হেড মাস্টার বলেছিল সমস্যা নাই, টেনশনের কিছু নাই সমাধান হবে। এভাবে করতে করতে পরীক্ষা চলে আসল। এরমধ্যে যখন যা চাইছে দিছি। এখন শুনতেছি যে আর পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। আমার ছেলেটার জীবনটা যে ওরা নষ্ট করল এর দায়টা কে নিবে। আমি তো একজন গবির মানুষ। আমি কত কষ্ট করে আমার ছেলেকে লেখাপড়া করাইছি সেটা তো আমি জানি। আমি এর বিচার চাই।
জয়দেব নামে আরেক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একজন শারিরীক প্রতিবন্ধী ছাত্র। প্রবেশ পত্র না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারিনি। বন্ধুরা সবাই যখন পরীক্ষা দিল আমি তখন বাড়িতে বসেছিলাম। এতোদিন কষ্ট করে পড়াশোনা করে আজ পরীক্ষা দিতে পারলাম না শুধুমাত্র হেড স্যারের গাফিলতির কারণে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ আমাদের জীবন এভাবে নষ্ট করার জন্য স্যারের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
এদিকে সারাদিনের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুললেও পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৫ শিক্ষার্থীর কেউই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেননি।
পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরীক্ষার প্রস্তুতি তেমন নিতে পারেনি তবুও পরীক্ষা খারাপ হয়নি। তবে স্যার যদি আমাদের এরকম হয়রানির মধ্যে না ফেলত অনেক ভালো পরীক্ষা হতো।
জেসমিন আক্তার নামে আরেক পরীক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদিন রাতের ঝামেলার পর পরীক্ষা নিয়ে অনেক টেনশনে ছিলাম। তারপর রাতে ঘুম হয়নি। পরীক্ষার খাতায় তেমন ভালো লিখতে পারিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল রাতে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। তাদের আশ্বস্ত করি প্রবেশপত্র দেওয়ার। পরে সবার চেষ্টায় রাতেই তাদের কাছে প্রবেশপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তারা পরীক্ষা দিতে পেরেছে। তবে রেজিস্ট্রেশন না হওয়ার কারণে তিনজনের প্রবেশ পত্র দেওয়া সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে ওই শিক্ষকের দোষ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরকে