আমের দাম নিয়ে হতাশ দক্ষিণাঞ্চলের চাষিরা
আমের কাঙিক্ষত দাম পাচ্ছেন না দক্ষিণাঞ্চলের চাষিরা। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। আমচাষিদের অভিযোগ- প্রশাসনের অজ্ঞতার কারণে এবার তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। সঠিক সময়ে আম নামানোর ক্যালেন্ডার ঠিক করতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ বছর আমের মুকুল এসেছে বিভিন্ন সময়ে। বেশিরভাগ গাছেই তিনবার মুকুল এসেছে। আগাম মুকুলের আম আগে পরিপক্ব হয়েছে। পরিপক্ব আম সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারার কারণে কাঙিক্ষত দাম পাচ্ছেন না আমচাষিরা।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আমের মোকাম বসে যশোরের শার্শা উপজেলার বেলতলায়। এ বাজারে যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার বিভিন্ন বাগান থেকে আম আসে। এখান থেকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ ক্যারেট আম দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এ মোকামে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে আম সংগ্রহ করে থাকেন। বর্তমানে সপ্তাহে সাত দিন আমের বাজার বসছে। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মেট্রিক টন আম বেচাকেনা হচ্ছে। আমের গুণগত মান ঠিক রাখতে আলাদা তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবার আমে ফরমালিন ব্যবহার রোধে গণসচেতনতাসহ প্রচার-প্রচারণা চালানোও হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আমচাষি শাহজাহান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর প্রশাসনের ক্যালেন্ডার নির্ধারণ ঠিক হয়নি। যে কারণে চাষিরা পরিপক্ব আম সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে পারছেন না। বেশিরভাগ চাষির এ বছর প্রতি বিঘায় ২০ হাজার টাকা করে লোকসান হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
যশোরের শার্শার ঘোড়পাড়া এলাকার বাগান মালিক ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, এ বছর কোনো কোনো গাছে তিনবার মুকুল এসেছে। আগাম মুকুলের কারণে আমও আগাম পরিপক্ব হচ্ছে, কিন্তু আমরা প্রশাসনের ক্যালেন্ডার মানতে গিয়ে ওই পরিপক্ব আম বাজারে তুলতে পারছি না। ফলে আম নষ্ট হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। যে কারণে আমের দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
সিরাজ হোসেন নামে স্থানীয় এক আমচাষি বলেন, আমরা বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক থেকে ঋণ করে আম চাষ করেছি। কিস্তির জন্য প্রতিদিন বাড়িতে এনজিও আর ব্যাংকের লোকজন ভিড় করে। আমের ব্যবসায় লোকসান। এখন আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় নেই।
নাভারনের আমচাষি সিরাজ শেখ বলেন, ৫ বিঘা জমিতে আমার আমের বাগান আছে। প্রতি বিঘায় ২০ হাজার টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরপর সার-কীটনাশকের দাম বেশি। এমন বাজার চলতে থাকলে চাষিরা না খেয়ে মরে যাবে।
এ বছর আম নামানোর ক্যালেন্ডার সঠিক সময়ে নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। ১০ মে থেকে আম নামানোর ক্যালেন্ডার নির্ধারণ করেছে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসন। যশোরের প্রশাসন এখনো ক্যালেন্ডার ঠিক করতে পারেনি। যে কারণে চাষিরা সময় মতো তাদের গাছের পরিপক্ব আম বাজারজাত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে তারা কাঙিক্ষত দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বেলতলা আম বাজারের আড়তদার আব্দুল মতিন মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমের ফলন ভালো। সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা আমাদের কাছে আম নিয়ে আসছেন, তবে আমরা তাদের ভালো দাম দিতে পারছি না। কারণ এ বছর আমের আগাম ফলন এবং ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মিল না থাকায় আমচাষিরা দাম পাচ্ছেন না। আমাদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে।
বেলতলা আমের বাজারে গোবিন্দভোগ, হিমসাগর, সরিসাখাস, বোম্বাই, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা, গোলাপখাস, রাণী পচ্ছন্দসহ আরও বিভিন্ন প্রকার জাতের আম আমদানি হয়ে থাকে। বর্তমানে এ বাজারে ৭ প্রকার আম আমদানি হয়েছে। প্রতিমণ হিমসাগর, গোবিন্দভোগ ও বোম্বাই আম ১ হাজার থেকে ১৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে, গুটি আম ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারী ব্যবসায়ী নুরুল কাদের বলেন, আমরা চাষিদের কাছ থেকে আম কিনে সেই আম বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে পাঠাতে আম পচে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ তাপদাহ এবং আমের আগাম ফলনের সঙ্গে প্রশাসনের ক্যালেন্ডার নির্ধারণের মিল না থাকা।
আবহাওয়াজনিত কারণে এ বছর আম ভাঙার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। প্রশাসন ক্যালেন্ডার ঠিক করতে না পারার কারণে সব আম একসঙ্গে পরিপক্ক হয়ে গেছে। প্রতি বছর দক্ষিণাঞ্চলের আম শেষ হওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের আম বাজারে ওঠে। কিন্তু এ বছর উত্তরবঙ্গের আম আগে বাজারে এসেছে। এসব কারণেই দক্ষিণবঙ্গের আমের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বেলতলার আম ব্যবসায়ী নেতা আরাফাত ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর আমের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু চাষিরা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। প্রশাসনের ক্যালেন্ডার সঠিক না হওয়ায় পরিপক্ক আম বাজারজাত করতে সময়ের হেরফের হয়েছে, যে কারণে আম নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং দামও পাওয়া যাচ্ছে না। এ বছর আমের আগাম ফলন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্যালেন্ডার নির্ধারণ না করে বাজারজাত করার সুযোগ দিতে হবে। তাহলে কৃষকও বাঁচবে, আমরাও পরিপক্ক আম বাজারে ওঠাতে পারব।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, আমচাষিরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিবিদ হাসান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। তবে আমচাষিরা বলছেন যে তারা ভালো দাম পাচ্ছেন না। আমরা চাষিদের কথা চিন্তা করে বিদেশে আম রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি এ বছরই আমরা যশোর অঞ্চলের আম বিদেশে পাঠাতে পারব। আর এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের চাষিরা অনেক লাভবান হবেন।
এ্যান্টনি দাস অপু/আরএআর