উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এই ঘূর্ণিঝড় যত এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে শঙ্কা। খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে মোখার প্রভাবে নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লেই দুর্বল বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ের প্রবেশের শঙ্কায় রয়েছে খুলনার উপকূলবাসী। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ। 

যদিও ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় উপকূলীয় তিন জেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে উপকূলের মানুষ বলছে- দুর্যোগ আসলেই শঙ্কা বাড়ে। ঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে অথবা উপচে প্লাবিত হয় লোকালয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলাশয়, ফসলের মাঠ ও ঘরবাড়ি।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা আগামী ১৪ মে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করবে। এর প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত করার শঙ্কা নেই। তবে এর প্রভাবে উপকূলে বৃষ্টি ও বাতাস হবে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. শফি উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল ৫ জেলায় আমাদের ১ হাজার ৮৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মোট ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার ৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

তিনি বলেন, অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতে কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড় যদি আঘাত হানে তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে ঝড়ের গতিপথ অনুযায়ী খুলনায় বড় ধরনের প্রভাব না পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমি নিজেও আজ দাকোপসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছি। কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে বলা হয়েছে।

খুলনার কয়রার নিতিশ সানা বলেন, ঝড় আসলেই শঙ্কা বাড়ে। এর আগে আইলা, আম্ফান ও ইয়াসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। মাছের ঘের, পুকুর ও ফসলের মাঠ লবণ পানিতে তলিয়েছে, ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা আসছে জানতে পেরে উপকূলের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে দুর্বল বাঁধ বালু ও মাটি দিয়ে উঁচু করা হচ্ছে। 

খুলনার কয়রা উপকূলের বাসিন্দারা জানান, তিন দিকে নদীবেষ্টিত কয়রার মূল সমস্যা নদী ভাঙন। যেকোনো দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও বাঁধ ভাঙে। ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টার পাশপাশি যারা দুর্দশায় আছেন তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে এ এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আবার জীবিকার অন্বেষণে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানায় সেবারও বাঁধ ভাঙে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় ২ বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল এবং অনেক পরিবারের জন্য বাঁধই ছিল একমাত্র আশ্রয়। ২০১১ সালে বাঁধ মেরামত করা হলে তারা তাদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফিরে যান এবং আবারো শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে বাধ্য হন। তারপর আঘাত হানে ইয়াস। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন ইয়াসে তার সবই আবার নোনাপানির নিচে তলিয়ে যায়। এভাবেই চলছে কয়রাবাসীর ভাঙা-গড়ার দুর্বিসহ জীবন।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো ঘূর্ণিঝড় মোখার তেমন কোনো  প্রভাব খুলনায় পড়েনি। ওইভাবে নাও পড়তে পারে। তবে জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে। আমরা দু-দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। উপজেলার প্রায় ১০টি স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ৪০ দিনের কর্মসূচি ও স্বেচ্ছাশ্রমে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।

পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করা হয়েছে। আশা করছি তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পাউবো খুলনার ডিভিশন-২ এর অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটারের ১৮টি পয়েন্ট। কয়রা উপজেলার দশালিয়া, শিকারীবাড়ি, নয়ানী, মঠবাড়ি, জোড়শিং আংটিহারা, গোয়ালখালী, দাকোপ উপজেলার খোনা, লক্ষ্মীখোলা, আচাবুয়া, বটবুনিয়া বাজার, পাইকগাছা উপজেলার চৌমহনা, মাহমুদকাঠি, বাসাখালী, বয়েরঝাপা, পার বয়েরঝাঁপা এলাকার সাতটি পোল্ডারের ১৮টি পয়েন্টে ৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে অথবা ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দুর্যোগকবলিত কয়রার বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে তারা স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে।

তিনি বলেন, আপাতত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। অন্য জায়গাগুলোতেও কাজ করা হবে।

এদিকে খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সভা করা হয়েছে। জেলার ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের জন্য শুকনো খাবার, পানি, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এছাড়া নির্দেশনা অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার মালামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষি, প্রাণীসম্পদ ও মৎস্য বিভাগকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বলা হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি দেখা হচ্ছে। দুর্যোগপূর্ব সার্বিক প্রস্তুতি আমরা গ্রহণ করেছি।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখনো ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়েনি খুলনায়। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। মানুষকে সচেতন করছি। বিপদ সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।

বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণঝড় মোখা মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পর্যবেক্ষণ করছে পাউবোর কর্মকর্তারা।

বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ৩০ হাজার জিও ব্যাগ ও ১০ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আজিজুর রহমানের বলেন, জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় ৪৪৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেখানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৫ জন আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, জেলা সদর ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ৯ উপজেলায় ৮৪টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কয়েকশ স্বেচ্ছাসেবকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি জানান, সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা না থাকলেও ঘূর্ণিঝড় মোখার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ও জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে প্রশাসন। জেলার ৮৮৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষের ধারণা ক্ষমতা রয়েছে। উপকূলের আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জে বেড়িবাধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারসহ পযাপ্ত জিও বালুর বস্তা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সংস্কারসহ পযাপ্ত জিও বালুর বস্তা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ঝড়ের পূর্বেই সংকেত অনুযায়ী মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রত্যেক ইউনিয়নে মেডিকেল টিম প্রস্তুতকরণ, পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও খাওয়ার পানি মজুত রাখা, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকদের সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। 

আরএআর