স্বেচ্ছায় রক্তদানে প্লাবনের অর্ধশতক
মানবতার সেবায় ব্রত হয়ে অনন্য এক কীর্তি গড়েছেন ময়মনসিংহের যুবক মমিনুর রহমান প্লাবন। ৫০ বার স্বেচ্ছায় রক্তদান করে ব্যতিক্রমী অর্ধশতক পূর্ণ করেছেন ‘ও’ নেগেটিভ এই রক্তদাতা। শনিবার (১৩ মে) দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক ও ট্রান্সফিউশন সেন্টারে নুরুজ্জামান নামে গফরগাঁওয়ের এক ব্যক্তিকে প্লাটিলেট দেওয়ার মাধ্যমে তিনি এই কীর্তি গড়েন।
নিজের রক্ত দিয়ে অন্যের জীবন বাঁচানো এবং সেই পরিবারের মুখে হাসি দেখে তৃপ্তি খুঁজে পান মমিনুর রহমান প্লাবন। যে গল্পের শুরুটা হয়েছিল ২০১০ সালে। তিনি তখন সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পায়ের অপারেশনের জন্য প্রয়োজন ছিলো ‘ও’ নেগেটিভ রক্ত। পরিবারের সদস্যরা হন্যে হয়েও খুঁজে পাচ্ছিলেন না সেই রক্ত। সেটি জানার পর হাসপাতালে ছুটে গিয়ে ওই রোগীকে রক্তদান করেন তিনি। সেই থেকে শুরু, এরপর টানা ১৩ বছর ধরে নিয়মিত রক্তদান করছেন প্লাবন। ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে করেছেন বিরল ‘ও’ নেগেটিভ রক্তদান। রক্তদাতা ও দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের কাছে তিনি খুবই পরিচিত ও অনুপ্রেরণার নাম।
বিজ্ঞাপন
শুধু রক্তদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন স্বেচ্ছাসেবী প্লাবন। ব্যক্তিগতভাবে দেড় হাজারের বেশি রোগীকে সহায়তা করেছেন রক্ত সংগ্রহ করে দেওয়ার মাধ্যমে। এছাড়াও রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে প্রায় তিনশ ডোনার তৈরি করেছেন, যারা এখন নিয়মিত রক্তদান করে যাচ্ছেন।
বড় পরিসরে কাজের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠনের সংগঠকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০১৬ সালে গঠন করা হয় ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি নামে একটি সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন প্লাবন। ওই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন তিনি। সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা দুই শতাধিক। যারা নিয়মিত রক্তদান করার পাশাপাশি প্রতিদিনই অসহায় রোগীদের জন্য রক্তদাতা সংগ্রহ করে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে রোগীদের।
বিজ্ঞাপন
দিন দিন বাড়ছে নীরব ঘাতক থ্যালাসেমিয়া। প্রতি বছর নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষ। সচেতনতার অভাব ও শনাক্ত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এ রোগের বাহক ও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতিনিয়ত অন্যের দান করা রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এ বিষয়টি রীতিমতো পোড়ায় ‘মানবিক’ প্লাবনকে। থ্যালাসেমিয়া আক্তান্ত রোগীদের বিভিন্ন সহায়তা ও সাধারণ মানুষকে এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় সচেতন করার লক্ষ্যে তিনি গড়েছেন ‘থ্যালাসেমিয়া সোসাইটি ময়মনসিংহ’ নামে আরেকটি সংগঠন। যেখানে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শনিবার ৫০তম রক্তদানের পর এসব নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় মমিনুর রহমান প্লাবনের সঙ্গে। প্লাবন বলেন, ২০০৮ সালে পহেলা বৈশাখের একটি অনুষ্ঠানে ব্লাড গ্রুপিংয়ের ক্যাম্পেইনে প্রথম জানতে পারি আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ। তখনই মনে অন্য রকম এক আবেগ তৈরি হয়েছিল। কারণ টেলিভিশনে প্রায়ই বিজ্ঞাপন দেখতাম ‘এক মুমূর্ষু রোগীর জন্য জরুরি ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন’। জানতাম এটি খুবই বিরল একটি গ্রুপ। এরপর প্রথম রক্ত দেওয়ার পর যাকে রক্ত দিয়েছিলাম সেই পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি এবং তারা আমাকে যেভাবে দোয়া করেছিলেন তাতেই আমার রক্তদান করার ব্যাপারে আরও আগ্রহী তৈরি করে তুলেছিল।
তিনি বলেন, রক্ত দিলে মানুষের উপকার হয়। কিছু দিন পরেই তো শরীরে নতুন রক্ত তৈরি হয়। মানুষের যখন রক্তের প্রয়োজন হয়, তখন রক্ত দিলে মানসিক যে তৃপ্তি, পৃথিবীর অন্য কিছুর বিনিময়ে সেই তৃপ্তি পাওয়া যাবে না। রক্তদানের পর বেশিরভাগ রক্তগ্রহীতার পরিবারের সঙ্গে অন্যরকম এক বন্ধন তৈরি হয়। পরিবারের কেউ না হয়েও প্রায়ই তারা খোঁজখবর নেন। এই ব্যাপারটি আমাকে এ কাজে আরও অনুপ্রেরণা যোগায়।
প্লাবন বলেন, আমার স্বপ্ন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর হবে ব্লাড ব্যাংক। থ্যালাসেমিয়ার বাহকমুক্ত প্রতিটি শিশুর জন্ম হবে। যতদিন পর্যন্ত সুস্থ আছি ততদিন পর্যন্ত নিজে রক্ত দিতে চাই ও তরুণ প্রজন্মকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে যেতে চাই। সেই সঙ্গে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিজের অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যেতে চাই।
প্লাবনের ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক ও ট্রান্সফিউশন সেন্টারের মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেন বলেন, আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছি। সেই সুবাদে শুরু থেকেই আমি প্লাবনের সঙ্গে বিভিন্ন কাজ করেছি। তার সঙ্গে পরিচয় মূলত ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি থেকে। তবে পরবর্তীতে করোনাকালে অসহায় মানুষকে সহায়তা করা, বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণসহ বেশ কাজ আমি তার সঙ্গে করেছি। এতে করে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তার মধ্যে একটি চমৎকার পরোপকারী মনোভাব রয়েছে। যেটা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক খারাপ অভ্যাস থেকে তরুণরা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে রক্তদান এবং রক্তদাতা তৈরির যে কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন সেটি সমাজের জন্য উৎসাহের একটি ব্যাপার।
মমিনুর রহমান প্লাবন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের আব্দুল মান্নানের ছেলে। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। তিনি ময়মনসিংহ নগরীর জামিয়া ইসলামিয়া থেকে কোরআনে হাফেজ, ঢাকার ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি থেকে ফিজিওথেরাপি, টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও তিনি গ্রীন ভিউ ল কলেজে এলএলবি শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। প্লাবন বর্তমানে ময়মনসিংহ ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
আরএআর