গ্রন্থাগারিক হত্যা: ইউএনওর দায়িত্ব অবহেলার তদন্তে গণবিজ্ঞাপ্তি
আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল
রংপুরে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক সাহিদুন্নবী জুয়েলকে (৫০) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন ইউএনওর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা অভিযোগ তুলে তদন্তে গণবিজ্ঞাপ্তি জারি করেছেন জেলা প্রশাসক।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) সকালে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে এ তদন্ত কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। বুধবার (২৪ মার্চ) লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
এরআগে গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রামের বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে সাহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়।
নিহত আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক।
বিজ্ঞাপন
গণবিজ্ঞাপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিকেলে বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে সাহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তৎকালীন পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহারের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগের তদন্ত করা হবে।
তাই বৃহস্পতিবার সকালে জনসাধারণকে উপস্থিত থেকে তদন্ত সহযোগিতা করার জন্য বলা হয়েছে। একইসঙ্গে বিজ্ঞপ্তিটি প্রচার করতে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যানকে অনুলিপি পাঠানো হয়।
জেলা প্রশাসকের জারি করা গণবিজ্ঞাপ্তির পত্র পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সদ্য যোগদান করা পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাম কৃষ্ণ বর্মণ।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় এ সিদ্ধান্ত তদন্ত শুরু হয়েছে। এটি প্রশাসনিক তদন্ত।
উল্লেখ্য, ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন সাহিদুন্নবী জুয়েল। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন পড়ে যায়।
এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।
পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম-বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন স্থানীয়রা। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
পরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর ও এসপি আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুমনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
নিহত জুয়েলের চাচাতো ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে হত্যাসহ পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার করা সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন দুটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
নিয়াজ আহমেদ সিপন/এমএসআর