‘মাও ছাড়া মোর কাও নাই’
‘যার মাও নাই তার জীবনের দুঃখ-কষ্ট কাও বোঝবার নায়। জন্মের কয়দিন পর বাবাক হারাচু। মা মোক ছোট থাকি বড় করচে। বিয়াও দেচে, কিন্তু সংসার টেকে নাই। মোর মাও ছাড়া আর কাও নাই। মাও মোর সোগকিছু, তার জন্যে বাঁচি আচু।’
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদী ঘেঁষা ধামুর এলাকার বাসিন্দা রাধা রানি। জন্মের কিছুদিন পর বাবাকে হারানো এ নারীর জীবনের পুরোটা জুড়ে আছেন তার মমতাময়ী মা।
বিজ্ঞাপন
রাধা রানি শাক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে দেশি শাক, কলার মোচা, শাপলা ও পদ্মসহ বিভিন্ন জাতের শাক সংগ্রহ করেন। এরপর গ্রামের মেঠোপথ ধরে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূর থেকে আসেন রংপুর শহরে। শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তার আগমন ঘটে।
সম্প্রতি রাধা রানির সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। দীর্ঘদিন ধরে শহরের জেলা পরিষদ সুপার মার্কেট সংলগ্ন ট্র্যাফিক আইল্যান্ডের সামনে রাস্তার পাশে বসে শাক বিক্রি করে আসছেন তিনি। হালকাপাতলা গড়ন, আলতো হাসিমাখা মুখ তার। বয়স ৩৩ ছুঁই ছুঁই। অভাব-অনটনের জীবন হলেও আফসোস নেই তার।
বিজ্ঞাপন
জানালেন, ১৪ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তবে স্বামীর সঙ্গে সংসার টেকেনি। স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় বিয়ের আট দিনের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয় তাদের। এরপর আর বিয়ের পিড়িতে বসেননি। নাম রাধা রানি হলেও জীবনের গল্পটা রানির মতো নয়। বৃদ্ধ মায়ের ভরণপোষণ আর দুবেলা দু-মুঠো ভাতের জন্য লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত। এখন শাক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।
রাধা রানি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। তার কোনো ভাইবোন নেই। তাই মায়ের দেখভাল করার জন্য ১৩ বছর ধরে নানা ধরনের শাক বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন তিনি।
দিনকাল কেমন যাচ্ছে, এ প্রশ্ন শুনতেই মুচকি হাসি দিলেন। যেন কোনো কষ্ট নেই তার। মৃদু স্বরে বললেন, ‘ভালোয় আছি। মাও থাকলে সগায় ভালো থাকে। যার মাও নাই, তার কষ্ট অনেক। হামার মাও-বেটির সংসারোত আর কাও নাই। এ্যালা মোর চিন্তা মাও কেমন করি ভালো থাকে। তার জন্য মোক বাঁচি থাকা নাগবে।’
রাধা রানির ভ্যানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কচুশাক, চামগাছ, কলার মোচা, শাপলা ও পদ্ম। দেশি শাকের চাহিদা থাকায় বিক্রিও মন্দ হয় না। শাক বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে মা-মেয়ের সংসার চলে যায়। রাধা জানালেন, গ্রামে নদীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা ধরনের শাক নিয়ে শহরে আসেন বিক্রি করতে। শুক্র ও শনিবার ছাড়া পাঁচ দিনই সন্ধ্যার পর শাক বিক্রি করেন।
শাক বিক্রি করে প্রতিদিন আয়রোজগার হয় ৪০০-৫০০ টাকা। আবার কোনো দিন এর বেশিও হয়ে থাকে। এই টাকা দিয়ে চাল, ডালসহ নিত্যপণ্য কিনে থাকেন। তবে বেশি টাকা ব্যয় হয় মায়ের চিকিৎসার জন্য। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শাক বিক্রি করে আসছেন রাধা রানি।
গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ধামুর এলাকায় এক শতক জমিও কিনেছেন। সেখানে টিনের ঘর তুলে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বসবাস করেন। রাধা রানির বাবার নাম উমাকান্ত, আর মা সুখসারি। শুক্র ও শনিবার শহরে আসেন না, ওই দু্ই দিন বাড়ির কাজ করেন। বাকি পাঁচ দিন শহরে সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২-১টা পর্যন্ত শাক বিক্রি করেন।
বাবা কীভাবে মারা গেছেন জানতে চাইলে রাধা বলেন, ‘তিস্তা নদীত মাছ ধরতে যায়া আকাশ থাকি পরা চরোকে (বজ্রপাত) মারা গেছে। তখন মোর বয়স মাত্র ১৯ দিন। এরপর মা আমাকে বড় করেছে। মুই ছাড়া মোর মাওর আর কাও নাই। ওই তকনে ব্যাটার দায়দায়িত্ব মুই পালন করো। কষ্ট হয়। মাও না থাকলে মোর দুইচোক যেদিকে যায় সেদিকে গেনু হয়। কিন্তু মাওর জন্য যাবার পাওনাই। যখন মাও মোক বুকোত জড়ে নেয় সোগ কষ্ট হারে যায়।’
রাধা রানিকে সুপার মার্কেট সংলগ্ন ওই বাজারে নিত্যদিন আসা কমবেশি সবাই চেনেন। নিজে বেঁচে থাকতে আর মাকে ভালো রাখতে রাধার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং চেষ্টায় খুশি অন্যরা। মানুষের কাছে হাত না পেতে কর্মমুখী হওয়া রাধার প্রশংসাও করেছেন অনেক ক্রেতা। এমনই একজন শাকিল মাসুদ, রাধার কাছ থেকে নিয়মিত শাক কিনে থাকেন তিনি।
শাকিল মাসুদ বলেন, রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রায় দিন রাধার কাছে কচুশাক কেনা হয়। সে দাম বেশি নেয় না। দেশি শাক খেতে ভালো লাগে। তাই তার কাছ থেকে প্রায়ই শাক কিনে থাকি। শাকগুলো পরিষ্কার থাকে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্নজনের কাছ থেকে শুনেছি রাধা রানি মায়ের চিকিৎসাসহ সংসারের হাল ধরতে শাক বিক্রি করে আসছে। এটা খুব ভালো দিক। অন্যের কাছে হাত পেতে কিছু নেওয়ার চেয়ে পরিশ্রম করে কিছু করতে পারাটাই শান্তির। রাধা জীবনযুদ্ধে পরাজিত হননি। কারও উপর নির্ভরশীল না। নিজের কাজ নিজে করে, এতে লজ্জার কিছু নেই।
এমজেইউ