ঐতিহ্যবাহী মসলিন আর বাংলার আদি রাজধানী ছাড়া লিচুর জন্যও বেশ বিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ। বাগানের গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ধরে আছে বাহারি জাতের লিচু। সারা দেশের মধ্যে লিচুর আগাম ফলন, রসালো ও সুমিষ্ট স্বাদের জন্য ক্রেতার পছন্দের শীর্ষে এখানকার লিচু। লিচু তোলার সময় ঘনিয়ে আসায় দিনের বেলায় বাঁশের তৈরি ঠাটারি (পাখি তারানোর যন্ত্র) বাজিয়ে পাখি তারাচ্ছেন বাগানিরা। বেশ কিছু বাগানের লিচু বিক্রয় উপযোগী হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে গাছ থেকে লিচু তুলে বাছাই শেষে আড়তে পাঠাতে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগানিরা।

সরেজমিনে সোনারগাঁয়ের বেশ কয়েকটি বাগান ঘুরে জানা গেছে, এ বছর ফলন বেশ ভালো হলেও শিলা বৃষ্টির ফলে লিচু ঝড়ে পড়ায় ও যথাসময় বৃষ্টি না হওয়ার ফলে লিচুর আকার কিছুটা ছোট হওয়াতে ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে এখানকার বাগানিরা। জাতভেদে সোনারগাঁয়ের লিচু ইতোমধ্যে বাজারে বিক্রি শুরু হয়েছে। সোনারগাঁয়ের পানাম নগর ও ঈসা খাঁর রাজধানী খ্যাত সোনরাগাঁ যাদুঘরে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা ও এখানকার বিভিন্ন বাগান থেকে সরাসরি লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ভোক্তা, পাইকার ও মহাজনদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে এখানকার লিচু বাগানগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দেরও আগে পর্তুগীজ পরিব্রাজকদের শখের বশে লাগানো লিচু গাছ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের সাড়ে ছয় শতাধিক লিচু বাগানির ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নে ও পৌরসভার হাড়িয়া চৌধুরী পাড়া, হাড়িয়া চক্রবর্তী পাড়া, নয়াপাড়া, কৃষ্ণপুড়া, দিয়া পাড়া, ঢাকারবন, ভবানীপুর, কাঞ্চনপুর, খাসেরকান্দা, দুর্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি গ্রামে প্রায় সাড়ে ছয় শতাধিক লিচু বাগান গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। সোনারগাঁয়ের লিচু বাগানগুলোতে মূলত পাতি, কদমি ও চায়না-৩ বা বোম্বে এই তিন জাতের লিচুর চাষ হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে কদমি লিচুর চাহিদা সব চেয়ে বেশি ও এর বাজার দর বেশ ভাল হওয়ায় এই জাতের লিচু চাষে আগ্রহী এখানকার বাগানিরা। আবহাওয়া ও আগাম ফলনের ফলে সারাদেশের মধ্যে মৌসুমের শুরুতে বাজারে ভোক্তার চাহিদা পূরণ হয় সোনারগাঁয়ের লিচুতে। এছারা রসালো সুমিষ্ট স্বাদের কারণে দেশের বিভিন্নস্থানের লিচুর তুলনায় সোনারগাঁয়ের লিচুর চাহিদাও অনেক বেশি।

সোনারগাঁয়ের পানাম নগর লাগোয়া লিচু বাগানি লিটন ঢাকা পোস্টকে জানান, এবছর বেশ ভালো ফলন হয়েছে। এক একটি থোকায় প্রায় ৪০-৫০টি করে লিচু এসেছে। যদিও ফলনের চেয়েও বেশি ছিল। শিলা বৃষ্টির ফলে অনেক লিচুই ঝড়ে পড়েছে। এছাড়া যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে গত বছরের চেয়ে লিচু আকারে কিছুটা ছোট হয়েছে। আমার বাগানের লিচুর হাজার প্রতি দাম উঠেছে পাঁচ হাজার টাকা। আমি ছয় হাজার করে দাম পেলে লিচু বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে যাই হোক এবারের ফলনে আমরা বেশ খুশি। আশা করি এবার লিচু বিক্রি করে লাভবান হব।

একই এলাকার আরেক বাগানী সোহেল আরমান বলেন, আমার মোট তিন বাগানের মধ্যে ২ বাগানের পাতি (দেশি জাত) জাতের লিচু বিক্রি হয়ে গেছে। এবার এই বাগানে কদমি জাতের লিচু গাছ থেকে পাড়া হচ্ছে। তবে বাজার থেকে আশানুরূপ দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া অতিরিক্ত গড়ম ও সুসময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় লিচুর আকার ছোট হওয়াতে আড়ৎ থেকে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সময় মত বাজারে লিচু বিক্রি করতে পারলে লাভবান হব বলে আশা করি।
 তুষার আহমেদ নামের এক দর্শনার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার কদমি লিচু ও বোম্বে লিচুর (চায়না-৩) চাহিদা বেশি। আকারে বড় ও রসালো স্বাদের জন্য এই লিচুকে অনেকে উপহাস করে বলেন ‘দিল্লি কা লাড্ডু’। সোনারগাঁয়ের যেমন ঐতিহ্য আছে, স্বাদের দিক থেকে এখানকার লিচুরও বেশ ঐতিহ্য আছে। আর তাছাড়া বাগান থেকে নির্ভেজাল লিচু নিতে আমার মত অনেকেই এখানে আসেন। শখ করে বাগান থেকে টাটকা ও নির্ভেজাল লিচু কিনে নিয়ে যান তারা।

সোনারগাঁ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, এই বছর ১০৫ হেক্টর জমিতে সাড়ে ছয় শতাধিক বাগানে মোট সাতশত মেট্রিক টন লিচু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পানাম নগর ও সোনারগাঁয়ের যাদুঘরের যেমন ঐতিহ্য আছে তেমনি সোনারগাঁয়ের লিচুরও ঐতিহ্য রয়েছে। এখানকার লিচু স্বাদের দিক থেকে দিনাজপুরের লিচুর মতো নয়, এর স্বাদ বেশ ইউনিক। প্রাথমিক পর্যায়ে বাগান করার সময় হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ হয় এক একটি লিচু বাগানে। এরপর আর তেমন খরচ না থাকায় লিচু চাষে ঝুঁকছেন এখানাকার বাগানিরা। জাতভেদে ৩-৬ টাকা দরে এখানকার লিচু বিক্রি হয়। সেই হিসাবে গড়ে প্রতি বাগানি ৪-৫ লাখ টাকা লাভ করবেন বলে ধারণা করছি।

আরকে