বরিশালে জাহাজে বিস্ফোরণে দগ্ধ সবাই মারা গেছেন
নিহত কুতুব উদ্দিন ভাসানী, ফরদিন আরাফাত স্বাধীন ও রুবেল (বাম থেকে)
বাবা ছিলেন এমটি এবাদী-১ জাহাজের প্রধান চালক। বাবাকে সমুদ্রে যেতে দেখে ছোটবেলা থেকেই নাবিক হতে চেয়েছিলেন ফরদিন আরাফাত স্বাধীন। একমাত্র ছেলের ইচ্ছার গুরুত্ব দিয়ে নদী বিদ্যার ওপরেই লেখাপড়া করানো হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কুমিরা রোজ গার্ডেন একাডেমি থেকে মাধ্যমিক ও একই উপজেলার বিজয় স্মরণী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মার্স মেরিন একাডেমি থেকে সি-ম্যান কোর্স করেন ফরদিন আরাফাত স্বাধীন।
পরিবারের উদ্যোগে ব্রাজিলে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করা করেন। ব্রাজিল যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে বরিশালে এসেছিলেন নদী যাত্রার অভিজ্ঞতা নিতে। সেই যাত্রাই শেষ যাত্রা হলো স্বাধীনের। শুধু স্বাধীন নয় তার পথ ধরে না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন বাবা কুতুব উদ্দিন ভাসানী।
বিজ্ঞাপন
শুধু বাবা-ছেলেই নয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ সবাই মারা গেছেন। এমটি এবাদী-১ তেলবাহী জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় মোট ছয়জন নিহত হয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, হৃদয়বিদারক খবর হচ্ছে এমটি এবাদী-১ জাহাজের ইঞ্জিন রুমে বিস্ফোরণে প্রথম দিনে তিনজন নিহত হন। পরে তিনজন দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বাবা-ছেলের শোকে কাতর উপজেলাবাসী
সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এমটি এবাদী-১ জাহাজের প্রধান চালক কুতুবউদ্দিন ভাসানী। তার তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলে স্বাধীন। তবে বিস্ফোরণে ১১ মে ইঞ্জিন রুমেই মারা যান ফারদিন আরাফাত স্বাধীন। তার চার দিন পর ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ১৫ মে মাঝরাতে মারা যান কুতুবউদ্দিন। তার শরীরের ৩০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল।
কুতুবউদ্দিনের ছোট ভাই মোনায়েম উদ্দিন সোহাগ বলেন, শিগগিরই বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল স্বাধীনের। স্বাধীন আর ফিরল না, ফিরল না আমার ভাইও। এরপর বাকরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। শোকে আর কিছু বলতে পারেননি।
নিহত কুতুবউদ্দিনের ফুফাতো ভাই ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন বলেন, আমার ভাইয়ের পরিবারটি শেষ হয়ে গেল। পুরো এলাকার মানুষ শোকে আচ্ছন্ন।
কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কুতুবউদ্দিন অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাদের পরিবারে এমন মর্মান্তিক ঘটনা সীতাকুন্ডবাসী মেনে নিতে পারছেন না।
রুবেলের সন্তানদের খাবারের নিশ্চয়তা নেই
অগ্নিকাণ্ডে জাহাজের শ্রমিক রুবেল দগ্ধ হয়েছিলেন ৯৫ শতাংশ। ১৪ মে রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রুবেল চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের হাছি মিয়ার ছেলে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে।
পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, মঙ্গলবার রুবেলের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ওর ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ে। পরিবার অত্যন্ত গরিব। রুবেলের মৃত্যুর পর ওর সন্তানরা কী খাবে সেই নিশ্চয়তা নেই। জাহাজ কোম্পানি থেকে কোনো সহায়তা করা হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে পরিবারটি।
আরও ৩ পরিবারে উপার্জনের কেউ নেই
জাহাজটির গ্রিজারম্যান ছিলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা বাবুল কান্তি দাস। এবারের ট্রিপ শেষে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরতে বেড়ানোর কথা ছিল। আর চট্টগ্রাম সদরের বাসিন্দা ক্লিনার কাশেম ও কামালও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তারা মারা যাওয়ায় পরিবারগুলো পথে বসেছে বলে জানিয়েছেন খালাসি সুমন সেন। তাদের মরদেহ নিয়ে দাফন করা হয়েছে। তবে কেউ সাহায্য করেছে কিনা তা বলতে পারেন না জাহাজের শ্রমিকরা।
জাহাজের বার্বুচি দুলাল বলেন, জাহাজে মোট ১৬ জন স্টাফ। এর মধ্যে দুইজন ছুটিতে বাড়ি গেছেন। ৬ জন নিহত হয়েছেন। আটজন বেঁচে আছি। কিন্তু চোখের সামনে সকলকে যেভাবে মারা যেতে দেখেছি তাতে আমরাও বেঁছে কতদিন থাকতে পারবো তা বলতে পারছি না। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছি। সব সময়ে তাদের (নিহত) কথা মনে পড়ে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ মে বিকেলে বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা নদীতে নোঙর করে রাখা সাড়ে ১৩ লাখ লিটার জ্বালানি তেল বহনকারী জাহাজ এমটি এবাদী-১ এর ইঞ্জিন রুমে বিস্ফোরণে ছয় জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি তদন্ত করা হয়েছে। জাহাজটি চট্টগ্রাম থেকে তেল নিয়ে এসেছিল।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর