সংসারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে নাইমুলের মাঠে খেলার সুযোগ হয়নি কখনও
নাইমুল ইসলাম (১২)। পড়াশোনা আর খেলাধুলা করার কথা থাকলেও সংসারের বোঝা কাঁধে নেওয়ায় একবেলা মাঠে যাওয়ার সুযোগ হয় না তার। বাবা অন্যত্র বিয়ে করায় মা, বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব এখন তার ঘাড়ে। তিন বছর ধরে পরিবারের হাল টানছে সে। মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে নাইমুলের বোঝা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছে।
শুক্রবার (১৯ মে) সকালে পালং বাজারের উত্তর মাথার একটি ওষুধের দোকানের সামনের ফুটপাতে মৌসুমি ফল লিচু বিক্রি করতে দেখা গেছে নাইমুলকে। স্কুল বন্ধ থাকলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সে। নাইমুল ইসলাম শরীয়তপুরের পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
বিজ্ঞাপন
চলমান এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষ্যে তার স্কুল বন্ধ। তার বড় বোন নুপুর আক্তার মুন্সীগঞ্জের একটি স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু টাকার অভাবে এক দিনের জন্যও বোনকে দেখতে যেতে পারেনি নাইমুল ও তার মা জিয়াসমিন বেগম।
শরীয়তপুর পৌরসভার ধানুকা এলাকার একটি বাড়ির ভাড়াটিয়া জিয়াসমিন বেগমের বাবার বাড়ি মাদারীপুর জেলার চৌরাস্তা এলাকায়। একই জেলার মোস্তফাপুর বড় ব্রিজ এলাকার সাইফুল ইসলাম নাইমুলের বাবা।
বিজ্ঞাপন
শিশু নাইমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলে, আমার বাবা ছোটবেলায় আমাদের রেখে অন্যত্র চলে গেছেন। মা, বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হয়। বোনটা পরীক্ষা দিচ্ছে। অভাবের কারণে বোনটাকে ভালো-মন্দ খাওয়ার জন্য টাকা দিতে পারি না। কাজের চাপে দেখতেও যেতে পারি না। স্কুলে আমি মর্নিং শিফটের সি শাখার শিক্ষার্থী হওয়ায় আমার ক্লাস হয় সকালে। ১২টা পর্যন্ত আমার মা দোকান পরিচালনা করেন। ১২টায় স্কুল ছুটি হলে আমি স্কুল থেকে সরাসরি দোকানে চলে আসি। এরপর মা বাসায় গিয়ে রান্না করে নিয়ে এলে খেতে পাই। কোনোদিন বিকেলে, কোনোদিন রাতে বাসায় যাই। ফলের কার্টনগুলোর ওজন অনেক বেশি। একা গুদাম থেকে দোকানে টেনে আনতে কষ্ট হয়।
নাইমুল আরও বলে, স্কুলে আমার বন্ধুরা টাকা নিয়ে এসে বিভিন্ন ধরনের খাবার কিনে খায়। আমি বন্ধুদের সঙ্গে মজাদার খাবার খেতে পারি না তাতে দুঃখ নেই। আমার স্কুলটি এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়ায় আমি দেখতে পেয়েছি, পরীক্ষা শেষে বড় আপু ও বড় ভাইদেরকে তাদের বাবা নিতে আসেন। আমার বাবা যদি থাকত, তাহলে আমার বোনকেও আনতে যেত। বাবা থেকেও নেই। আমার বোন না খেয়ে একা একা পরীক্ষা দেয়। জানি না খালার বাড়িতে নুপুর আপু কেমন আছেন! এসব মনে পড়লে পকেটে টাকা থাকলেও স্কুলের টিফিনে কিছু কিনে খেতে ইচ্ছে করে না।
নাইমুলের মা জিয়াসমিন বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাইমুলের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন ২০১৪ সালে। এরপর ২০১৮ সালে তার সঙ্গে আমার আবার মিলমিশ হয়। কিন্তু ২০২০ সালে ছোট ছেলে আলিফকে ১ মাস ৯ দিন বয়সে আমার কাছে ফেলে রেখে চলে যায়। তারপর আমি ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পথে পথে ঘুরছি। যখন যে জেলায় কাজ পেয়েছি, সেখানে গিয়েছি। নাইমুল এত কম বয়সে মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর, রাজধানী ঢাকা ও শরীয়তপুরে বসবাস করার কারণে নিয়মিত কোনো স্কুলে যেতে পারেনি। আমার নাইমুল পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে কোনোদিন মাঠে খেলতে যেতে পারেনি। এখনও তাকে বই কিনে দিতে পারিনি। প্রাইভেট পড়াতে পারছি না। ছোট ছেলেটা মাংসের পাগল। জীবিকার তাগিদে বাজারে এলেও আমি মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে যাই না। গেলে আমার কান্না পায়। আমার বাবা ও শ্বশুর বাড়ি মাদারীপুর হওয়ায় আমাকে কেউ সাহায্য করে না। মাদারীপুর গিয়ে আমি কী করবো? সেখানে তো জায়গা জমি নেই। শরীয়তপুরের মানুষগুলো অনেক ভালো। আমি এখানে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে চাই। কিন্তু আমাকে কী চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সেই সুযোগ দেবেন! আল্লাহ ছাড়া আমার কেউ নেই। আমার ছেলে-মেয়েরা মেধাবী। যদি কেউ ওদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিত তাহলে পড়াশোনা করে আমার সন্তানরা ভালো থাকত।
বাজারের দোকানদার মো. আলম মাদবর ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরের বিভিন্ন সময় কখনও পিঠা, কখনও মৌসুমি ফল ও সবজি বিক্রি করে নাইমুল। মেধাবী ছেলে নাইমুল। মা, বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে। গত বছর থেকে নাইমুল পালং বাজারে বিভিন্ন মৌসুমি ফলের ব্যবসা শুরু করেছে। এই বয়সে তার খেলার মাঠে থাকার কথা কিন্তু বাস্তবতার জন্য সারাদিন দু-মুঠো ভাতের আশায় পরিশ্রম করে সে।
ক্রেতা মো. সোহেল জানান, নাইমুল সৎভাবে ব্যবসা করে। ছলচাতুরী করে কাস্টমারদের ঠকাতে দেখিনি কখনও।
ফুটপাতের ব্যবসায়ী নাইমুল ইসলাম সম্পর্কে পালং বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাইমুল স্থানীয় স্কুলের ছাত্র। ধানুকার ভাড়াটিয়া নাইমুলকে বণিক সমিতির মাধ্যমে পালং বাজারের ফুটপাতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। মা, বড় বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে সংসারে নাইমুলের খরচ অনেক। শরীয়তপুরে অনেক খাসজমিতে ভাসমানদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। যদি ইউএনও ও ডিসি মহোদয় পড়াশোনার খরচ ও তাদেরকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিতেন তাহলে মেধাবী নাইমুল, তার বোন ও ভাই পড়াশোনা করে দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারত। আমি প্রশাসন ও মেয়র মহোদয়কে নাইমুলের মা জিয়াসমিনের জন্য দ্রুত একটি কাজের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করবো। এছাড়া বণিক সমিতি নাইমুলের পাশে থাকবে সব সময়।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেধাবী নাইমুলের বিষয়টি জানতে পেরেছি। সে গত তিন বছর ধরে পালং বাজারে হকারির মাধ্যমে বিভিন্ন মৌসুমি ফল বিক্রি করে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি তার মা জিয়াসমিনের নাগরিকত্ব মাদারীপুরে। যেহেতু তারা শরীয়তপুরে ভাড়া থাকেন, সেহেতু সাময়িকভাবে যেসব সহযোগিতা তাকে দেওয়া সম্ভব তা দেওয়ার চেষ্টা করবো। যদি নাইমুলের মা তার নাগরিকত্ব শরীয়তপুর সদরে নিয়ে আসেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের যে ঘর রয়েছে তার মাধ্যমে বসবাসের স্থায়ী ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া পড়াশোনার খরচের বিষয়ে তার পরিবারের পাশে থাকবে প্রশাসন।
সাইফুল ইসলাম সাইফ/আরকে