‘ওজন মাপার মেশিনেই ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করি’
ষাটোর্ধ্ব হাবিব খান। আগে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার সময় চাকরিটা চলে যায়। এরপর সংসারে নেমে আসে অভাব। বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন মাদারীপুরের নিজ গ্রামে। জাগো ফাউন্ডেশন নামের একটি স্কুলে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই স্ট্রোক করেন তিনি। তারপর মাদারীপুর-ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নেন। এতে অনেক টাকা ব্যয় হয় তার। তারপরও পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। ডাক্তার বলেছেন, উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার। কিন্তু তার কাছে আর কোনো টাকাপয়সা নেই। এতদিন ধারদেনা করে চিকিৎসা নিলেও এখন তিনি একেবারেই নিঃস্ব।
হাবিব খান মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ঝাউদি গ্রামের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার হাবিব খানের। তার স্ত্রী গ্রামের এক বাড়িতে বুয়ার কাজ করেন। ছেলে কলেজে পড়াশোনা আর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে হাবিব খান বলেন, আমি স্ট্রোক করার পর শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাই। তাই ভারী কাজ করতে পারি না। এদিকে বয়স ষাটের বেশি হয়েছে। সামান্য কাজ করলেই হাঁপিয়ে যাই। স্ত্রীরও বয়স হয়েছে। তারপরও সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কোনো উপায় না পেয়ে একজনের কাছ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা ধার করে ওজন মাপার মেশিনটি কিনি। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মাদারীপুরের শুকনি লেকপাড় বসে মানুষের ওজন মাপি। এতে যা আয় হয় তা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করি।
তিনি আরও বলেন, ওজন মেপে কোনোদিন ২০০ আবার কোনোদিন ৩০০ টাকা রোজগার হয়। শুক্র আর শনিবার একটু বেশি আয় হয়। মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা রোজগার হয়। এ টাকা দিয়ে কিস্তি পরিশোধ করবো নাকি সংসার চালাব বুঝতে পারি না। তাই মাঝে মাঝে ওষুধ না কিনে চাল-ডাল কিনে আনি। আমার মতো বৃদ্ধ লোকদের দেখি ভিক্ষা করতে। কিন্তু আমার ভিক্ষা করতে লজ্জা করে। তাই সরকার ও বিত্তবানরা যদি আমার দিকে একটু তাকায় তাহলে আমি বাঁচতে পারব, আর না হয় এভাবেই মরে যেতে হবে।
বিজ্ঞাপন
হাবিব খানের স্ত্রী তাসলিমা খানম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে লেকপাড়ে মানুষের ওজন ও উচ্চতা মেপে সারাদিনে ৩০০ টাকা রুজি করতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। এই টাকা দিয়ে ওষুধ কিনব নাকি খাবার কিনব এই চিন্তায় আমরা শেষ।
পথচারীরা সিহাব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক লোককে দেখি ভিক্ষা করতে। কিন্তু এই চাচা মেশিনের মাধ্যমে মানুষের ওজন মেপে যা টাকা পান এতে তার খাওয়াদাওয়া ও চিকিৎসা করা ভীষণ কষ্ট হয়ে পড়ে। তাই সরকার এবং বিত্তবানদের তার পাশে দাঁড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।
আরেক পথচারী মামুন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি (হাবিব খান) হাঁটতে গেলেই কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যান। তাকে টুল দেওয়া হয়েছে। টুলের উপর বসে বসে মানুষদের ওজন মাপেন। এতে কেউ তাকে পাঁচ টাকা, আবার কেউ দশ টাকা দিয়ে যান। এতে তার যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো বা ওষুধ কেনা সম্ভব হয় না। সরকার যদি তাকে একটি স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে হয়ত মানুষটা বাঁচতে পারত।
হকার কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাবিব ভাই বৃদ্ধ মানুষ। এভাবে কাজ করতে পারেন না। তার চলাচল করতেই অনেক কষ্ট হয়। সরকার যদি একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে অনেক ভালো হত।
ঝাউদি ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. নেছার উদ্দিন মূন্সী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তাকে স্থানীয়ভাবে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। ইউনিয়ন পরিষদে কোনো বরাদ্দ এলে তাকে সহযোগিতা করা হবে। এই বৃদ্ধ মানুষটিকে সাহায্য করার জন্য বিত্তশালীদের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আপনাদের একটু সহযোগিতায় তিনি বেঁচে যেতে পারেন।
মাদারীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে আবেদন করলে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী তাকে সহযোগিতা করা হবে।
রাকিব হাসান/এমজেইউ