নীলফামারীর ডিমলার যুবক বাদশা মিয়া। স্নাতক শেষ করেই অভাবের সংসারের হাল ধরতে সরকারি ও বেসরকারি চাকরির চেষ্টা করেছিলেন। প্রায় ২০টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার পরও মেলেনি চাকরি। এক সময় পার হয়ে যায় সরকারি চাকরির বয়সের সীমা। পরে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে নিজের শিক্ষাজীবনে অর্জিত সকল একাডেমিক সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলেন তিনি। এখন বেকারত্বের জীবন নিয়ে বাঁচার সংগ্রাম করছেন তিনি।

পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে সংসারের হাল ধরতে বাদশা শুরু করেছেন কৃষিকাজ। সামান্য আবাদি জমির ফসল দিয়ে কোনো রকমে দিনযাপন করছে তার পরিবার।

বাদশা মিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সুন্দর খাতা গ্রামের বাসিন্দা মহুবার রহমানের ছেলে। পরিবারে ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাদশা পাঙ্গা চৌপতি আব্দুল মজিদ দাখিল মাদরাসা থেকে ২০০৭ সালে জিপিএ ৩ দশমিক ৯২ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে দাখিল, ২০০৯ সালে সোনাখুলি মুন্সিপাড়া কামিল মাদরাসা থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ০৮ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে আলিম এবং ২০১৪ সালে নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তবে অর্থের অভাবে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারেননি বাদশা।

মঙ্গলবার (৩০ মে) দুপুরে ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সুন্দর খাতা গ্রামের ধানখেতে দেখা হয় বাদশা মিয়ার সঙ্গে। তীব্র রোদ উপেক্ষা করে নিজের জমির ধান কেটে কাঁধে নিয়ে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসছেন ওই যুবক। বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে সহযোগিতা করছেন তিনি।

বাদশার বাবা মহুবার রহমান বলেন, চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ায় বেশ কিছুদিন থেকে হতাশায় ভুগছিল বাদশা। দিনে দিনে হতাশা বেড়ে যাওয়ায় সে তার একাডেমিক সার্টিফিকেটগুলো কাউকে না জানিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। বর্তমানে সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। নিজের মাত্র তিন বিঘা জমি। তিন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর এখন সঞ্চয় বলে কিছু নেই। ছোট ছেলে বিএ পড়ছে। সবকিছু মিলে বেকার ছেলে বাদশাকে নিয়ে মাঠে কাজ করছি।

জানতে চাইলে বাদশা মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা খেয়ে না খেয়ে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অসহায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। এরা না পারে চাকরি জোটাতে, আবার অর্থের অভাবে না পারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। তাই চুপিসারে ঢাকা ও বগুড়া শহরে প্রায় সময়ে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছি। এলাকার কৃষি শ্রমিকদের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জায়গায় কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে।

বাদশা আরও বলেন, সনদ ছিঁড়ে ফেলার পর রোজ নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিস আমাকে চাকরি দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তিন মাস চাকরি করার পর এক মাসের বেতন দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। অপর দিকে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঢাকায় কনস্ট্রাকশনের কাজে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে শ্রমিক হিসেবে আমাকে দৈনিক হাজিরায় কাজ দেওয়ায় তা ছেড়ে চলে আসি।

এর আগে ফেসবুক লাইভে সনদ ছিঁড়ে বাদশা বলেছিলেন, আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ! কত মানুষ ভুয়া সার্টিফিকেট বানিয়ে চাকরি করছে। আর আমি এত সার্টিফিকেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও একটা সরকারি বা বেসরকারি চাকরি জোটাতে পারিনি। সনদপত্র অনুযায়ী চাকরির বয়স শেষ, এখন এগুলো রেখে লাভ কী? বয়স থাকতেই তো চাকরি জোটাতে পারিনি।

ওই লাইভে বাদশা আরও বলেন, আমার বাবা খেয়ে না খেয়ে আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাই-বোনদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অসহায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেরা। এরা না পারে চাকরি জোটাতে, আবার অর্থের অভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করতে।

এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাকরির আশ্বাস আমি কাউকেই দেই নাই। আমরা যেটা করতে পারি উপজেলা পরিষদ থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় অথবা যুব উন্নয়ন থেকে কিংবা সমবায় থেকে যে প্রশিক্ষণগুলা হয় এরকম প্রশিক্ষণ দিয়ে তার দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবো। এর আগে তার বিষয়টি যখন পত্রিকায় এসেছিল তখন ঢাকা থেকে একজন ভদ্রলোক আমাকে ফোন করলেন, পরিচয় দিলেন তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। পরে তিনি বাদশাকে একটা চাকরি দিতে পারবেন বলে জানান। এ নিয়ে বাদশার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করে দেই। এরপর তার চাকরি ছেড়ে চলে আসার বিষয়টি জানা ছিল না।

শরিফুল ইসলাম/এবিএস