কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কাকিলাদহ গ্রামের রাস্তার দুপাশ, ফসলের মাঠ, মেঠোপথ, বাড়ি-পুকুরের আশপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ হাজার তালগাছ। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই তালগাছের নৈসর্গিক দৃশ্য চোখে পড়ে।

কাকিলাদহ গ্রামের বাসিন্দা মৃত দাউদ বিশ্বাস অনেক জায়গা-জমির মালিক ছিলেন বলে প্রায় ৬ যুগ আগে নিজের জমির সীমানায় ও সড়কের পাশে অসংখ্য তালগাছ রোপণ করেন তিনি। পরে তার দেখাদেখি স্থানীয় অনেকেই তালগাছ রোপণ করা শুরু করেন বলে জানা যায়। এভাবে কাকিলাদহ গ্রামটি তালগাছের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবছর চৈত্র মাস থেকে শুরু করে প্রায় চার মাস রস কাটা হয়। এ সময় তালের রস, কাঁচা তাল, তালের গুড়, পাকা তাল, তালের গাছ ও পাতা বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন গাছ মালিকরা। তালগাছকে কেন্দ্র করে এ গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। জানা যায়, এক মৌসুমে প্রায় দুই কোটি থেকে আড়াই কোটি টাকার রস, তাল ও গুড় বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, সুস্বাদু তালের রস ও তাল খেতে প্রতিদিন ভিড় করেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন।

৫৭ বছর বয়সী ইমাম আলী প্রায় দুই যুগ ধরে তালের রস সংগ্রহ করেন। তার প্রায় ৫০টি তালের গাছ রয়েছে যেগুলো তিনি নিজের জমির সীমানায় লাগিয়েছেন। ইমাম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জন্মেরও অনেক আগে আমাদের গ্রামের বিত্তবান ও বহু জমিজমার মালিক দাউদ বিশ্বাস সর্বপ্রথম তালগাছ লাগানো শুরু করেন। তার দেখাদেখি এই এলাকার মানুষ অসংখ্য তালগাছ লাগান। আমিও তাদের দেখাদেখি তালগাছ লাগিয়েছিলাম। আমার ৫০টি তালগাছ আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, তাল গাছ থাকার কারণে আমাদের এলাকায় বজ্রপাতে কেউ মরেনি। এ বছর আমি দুটি তালগাছ থেকে নিজেই রস সংগ্রহ করি। একটি তালগাছ থেকে প্রতিদিন ৫ ভাঁড় করে রস পাওয়া যায়। এক ভাঁড়ে ১৫ গ্লাস রস হয়। সেসব রস গাছ থেকে নামিয়ে রাস্তার ধারে বসে ১০টাকা গ্লাস করে সকাল ও বিকেল দুই বেলা বিক্রি করি। প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার রস বিক্রি করি। আমাদের তালের রস খুব সুস্বাদু। এজন্য দূর দূরান্ত থেকে তালের রস খেতে আসে অনেক মানুষ। আমি প্রায় দুই যুগ ধরে তালের রস ও তাল বিক্রি করি। এ বছর তাল ও রস বিক্রি করে দুই লাখ টাকা আয় হবে। আয়ের টাকায় জমি নিয়েছি। চার মাসের পরিশ্রমের টাকায় সারা বছর সুখে-শান্তিতে পাঁচজনের সংসার চলে যায়। এক মৌসুমে প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার রস, তাল ও গুড় বিক্রি হয়।

তাল বিক্রেতা আবু সাইদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার নিজের কয়েকটি তালগাছ আছে। তাছাড়া অন্যের গাছের তাল কিনেও বিক্রি করি। প্রতিবছর এই মৌসুমে তাল বিক্রি করি। একটা তালের শাঁস দুই টাকা দামে বিক্রি করছি। অন্য জায়গার চেয়ে আমরা অনেক কম দামে তাল বিক্রি করি। এক গাছের তাল বিক্রি করে দুই হাজার টাকা আয় হয়। এই মৌসুমে আমাদের ভালো আয়-উপার্জন হয়।

তাল ও রস বিক্রেতা ইকরাম আলী বলেন, এই গ্রামে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার তালগাছ রয়েছে। প্রায় এক হাজার গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। অসংখ্য গাছের কাঁচা তাল ও পাকা তাল বিক্রি হয়। এতে ব্যাপক লাভবান হন তালগাছ মালিক ও তাল-রস ব্যবসায়ীরা। এখানকার রস ও তাল খাওয়ার জন্য দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসেন।

স্থানীয়রা ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমানে এই গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার তালগাছ রয়েছে। শতাধিক পরিবার এই মৌসুমে তাল ও রস বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করে। অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছেন। সেই সঙ্গে তালগাছ বেশি থাকায় বজ্রপাতে প্রাণহানি হয় না। তালগাছ মালিক নিজে রস ও তাল বিক্রি করেন। অনেকে আবার এক মৌসুমের জন্য তালগাছ বর্গা দেন, গাছ হিসেবে তাল বিক্রি করে দেন। আমাদের গ্রাম এখন তালগাছের জন্য বিখ্যাত।

ইমন আলী বলেন, আমি ও আমার বন্ধুরা দৌলতপুর থেকে তালের রস খেতে কাকিলাদহ গ্রামে এসেছি। এখানকার রস অনেক সুস্বাদু। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে তাল ও রস খেলাম, অনেক সুন্দর পরিবেশ, চারপাশে শুধু তালগাছ আর তালগাছ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এমন দৃশ্য খুব উপভোগ করছি, খুব ভালো লাগছে।

এ বিষয়ে সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম বলেন, কাকিলাদহ গ্রামে অসংখ্য তালগাছ রয়েছে। তালের রস বিক্রি করে গাছ মালিকরা বেশ সফলতা পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তালগাছ খুবই উপকারী, সেই সঙ্গে সেখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছে ওই এলাকার মানুষ।

এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ। 

তবে, এ বিষয়ে মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিরপুর উপজেলায় রাস্তার পাশে, জমির সীমানায়, পুকুর পাড়সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৩২ হেক্টর জমিতে তালগাছ রয়েছে। তার মধ্যে কাকিলাদহ গ্রামের তালগাছের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ওই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে তালগাছ রয়েছে। সেখানকার তালের রস খুবই জনপ্রিয়। তালের রস ও তাল বিক্রি করে গাছ মালিক ও সংশ্লিষ্টরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষায় তালগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বজ্রপাত রোধক হিসেবেও কাজ করে।

রাজু আহমেদ/এবিএস