রংপুর শহরতলীর নাচনিয়ায় স্তূপাকারে ফেলে রাখা হয়েছে শত শত মেট্রিক টন ময়লা-আবর্জনা। ছোট ছোট পাহাড়ের উঁচু টিলার মতো আবর্জনার স্তূপ থেকে ভেসে আসছে অট্টহাসি। দুর্গন্ধময় সেই হাসিটা যেন নগরবাসীর চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির বার্তা। ময়লা-আবর্জনার বিশাল এ ভাগাড় থেকে থেমে থেমে ভেসে আসা হাসির শব্দটা এক শিশুর। সাত বছর বয়সী ছোট্ট শিশুটি হাসছে আর বলছে ‘আমাকে তোমরা নিষিদ্ধ ঘোষণা কর, নাহলে আমি তোমাদের কাউকে ছাড়ব না’।

নগরবাসীসহ সব মানুষের প্রকৃতি, পরিবেশ, নদ-নদী, খাল-বিলকে বাঁচানোর জন্য পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের আকুতি জানিয়ে সচেতনতার বার্তা ছড়ানো শিশুটির নাম জান্নাতুল মাওয়া। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পলিথিন চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপন করেছে মাওয়া। তার অভিনয়ের একটি ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। রোববার ভিডিওটি রংপুর মহানগরীর নাচনিয়া এলাকায় ধারণ করা হয়।  

আরও পড়ুন : তোমরা আমাকে বাঁচাও, আমি তোমাদের শ্যামা

চার মিনিট সাতাশ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে নিজেকে পলিথিন উল্লেখ করে শিশুটি বলতে থাকে, ‘আমাকে চিনতে পারছো কি? আমি তো তোমাদের সবখানেই আছি। রান্নাঘর, দোকানপাট, শপিংমল সবখানেই আমি আছি। আমি নদীগুলোর তলদেশ ভরাট করতে করতে ডোবা বানিয়ে ফেলি। যখন বৃষ্টি হয়, তখন তোমাদের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। তোমরা পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকো। ভারি বর্ষণে তোমাদের শহর ডুবে যায়।’

‘আমি তোমাদের জমিগুলোর ঊর্ব্বরতা নষ্ট করি। তোমরা চাষাবাদ করতে পারবে না। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমরা জানো না।  আমাকে কতদিন আগে তোমরা ছুড়ে ফেলেছো, কিন্তু আমি পঁচে-গলে যাইনি। বরং আমি বাড়তে বাড়তে ময়লার স্তুপ হয়ে গেছি। তোমরা আমাদের রাস্তায় ফেলে দাও, আমি সেখানেও জমতে জমতে স্তুপে পরিণত হই। তোমরা আমার পাশ দিয়ে গেলে নাক ছিটকে ধর নয়তো নিঃশ্বাস বন্ধ কর। কারণ আমার অনেক গন্ধ।’

‘আমাকে তোমরা যখন রাস্তায় ফেলে রাখো, আমার ওপর পানি জমে। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা হলে আমার ওপর পানি জমে, সেখানে ডেঙ্গু মশা বংশ বিস্তার করে। সেই মশা আবার সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। মশার কামড়ে অনেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আবার কেউ কেউ অসুস্থ হয়।’

পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ তুলে ধরে ভিডিওতে শিশুটি বলেছে, তোমাদের দেশে সোনালী আঁশ আছে। তোমরা সেই সোনালী আঁশ দিয়ে তৈরি পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে পার। কিন্তু তোমরা তো শুধু স্বস্তা খুঁজে থাকো। স্বস্তা জিনিস ছাড়া তোমরা কিছুই জানো না। তাই তোমরা আমাদের ব্যবহার কর। কিন্তু তোমরা কি জানো না, আমি প্রকৃতি, পরিবেশ দূষণ করি।’

‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাজারে যাও, আবার ফ্রিজেও রেখে দাও। আমি তোমাদের ব্যাকটেরিয়া ধরাতে পারি। ডায়রিয়া ধরাতে পারি। হার্টের ও কিডনির ক্ষতি করতে পারি। এমন আরও অনেক ক্ষতি করতে পারি আমি। তোমরা যদিও আমাকে নিষিদ্ধ না কর, তাহলে তোমাদের প্রকৃতি একদম দূষণ হয়ে যাবে। তোমরা যদি আমাদের ব্যবহার করা না ছাড়ো, তাহলে আমি আমার শক্তিশালী থাবা দিয়ে আরও কঠিন হয়ে উঠব। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য তোমরা এখনই আমার ব্যবহার বন্ধ করে আমাকে নিষিদ্ধ কর।’

ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া। তার মা মনিরা আকতার পেশায় শিক্ষক। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রতীকী অভিনয় করে পলিথিনের ভয়াবহতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মাওয়া। 

এদিকে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ না হওয়ায় রংপুরে বাড়ছে দূষণ। পলিথিনময় ময়লা-আবর্জনার স্তূপে হুমকিতে পড়ছে প্রকৃতি-পরিবেশ। সঙ্গে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছেন নগরবাসী। পলিথিনের কারণেই মাটি, পানি ও বায়ু দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিনিয়ত চারপাশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। দূষণের কারণে প্রকৃতি ও মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকৃতি ও মানুষকে বাঁচাতে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করলেও দূষণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। রংপুর অঞ্চলে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ, নদীদূষণ ও বর্জ্য দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

জানা গেছে, রংপুর সিটি করপোরেশন ৩৩ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে পুরনো ১৫টি ওয়ার্ডে বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এই ১৫টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ১০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ টন বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয়। বাকি ৩০ থেকে ৩৫ মেটিক টন বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব বর্জ্য পচে-গলে দুর্গন্ধ বাতাসে মিশে মারাত্মক বায়ু দূষণ করছে। এসব বর্জ্য হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এর আবর্জনা, শিল্প কারখানা হতে উৎপাদিত আবর্জনা, রান্নাঘরের পরিত্যক্ত আবর্জনা, হাটবাজারের পচনশীল শাকসবজি, কসাইখানার রক্ত অন্যতম উৎস। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখায় বাতাস ও মাটি দূষিত হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্যের ফলে আশেপাশে দুর্গন্ধের পাশাপাশি দেখা যায় মশা, মাছি ও পোকামাকড়ের মাত্রাতিরিক্ত উপদ্রব। বর্ষা মৌসুমে বর্জ্যগুলোর অবস্থা হয় আরও ভয়াবহ।

এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন আড়াই টনের ওপর ক্লিনিক্যাল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর বর্জ্যের মাত্র দেড় টন সিটি করপোরেশন অপসারণ করে থাকে। ক্লিনিক্যাল বর্জ্য মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জনজীবনে। প্লাস্টিক ও পলিথিনে দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে কথা হলেও এর দূষণ রোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন রংপুরসহ আশপাশ এলাকায় লাখ লাখ পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চললে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি।

রংপুর বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দ ফরহাদ হোসেন বলেন, সম্প্রতি বায়ু দুষণ, সবুজ শিল্পায়ন ইটভাটা নিয়ে পৃথক পৃথক সেমিনার হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ চলছে। পলিথিনে ব্যবহার বন্ধে পাট, কাগজ, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে ক্রেতা ও ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস