খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ৪০ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের ব্যাংকুয়েট হলে তিনি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।

ইশতেহারে তিনি খুলনা মহানগরী সম্প্রসারণসহ ৪০ দফা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ইশতেহার ঘোষণার আগে গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করা উন্নয়ন প্রকল্পের বর্ণনা দেন তালুকদার আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে দেশের সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে যা প্রায় তিন বছর স্থায়ী ছিল। সেই কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও যথাসময়ে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে নগরবাসীকে হয়ত কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিলম্বের জন্য নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে চলমান উন্নয়নকাজ সমাপ্ত হলে খুলনা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি স্বাস্থ্যকর নগরীতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।

নৌকার এই প্রার্থী বলেন, আগামী ১২ জুন খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে আমি নতুন প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার নিয়ে আমার নির্বাচনী ইশতেহার তুলে ধরছি। কেসিসিকে ঘিরে আমার নতুন চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা আপনারা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা করি।

৪০ দফার মধ্যে রয়েছে- পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও পরিবেশবান্ধব খুলনা গড়ে তোলা, পার্ক-উদ্যান নির্মাণ ও বনায়ন সৃষ্টি, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ড্রেন পরিষ্কার, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বৃক্ষ পরিচর্যা ও সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন অনিরাপদ স্বাস্থ্যকর খুলনা, সুলভ মূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবা, সূর্যোদয়ের আগেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, মাদকমুক্ত নগর গড়ে তোলা, সড়কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, পথচারী বান্ধব ফুটপাত, মানবিক উন্নয়নের খুলনা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান উপযোগী নগরী, সিভিক সেন্টার গড়ে তোলা, অনুদান তহবিল চালু, মিডিয়া সেন্টার চালু ও সেরা সংবাদ পুরস্কার প্রবর্তন, কবরস্থান ও শ্মশান ঘাটের উন্নয়ন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবছর প্রতিযোগিতার আয়োজন, স্মার্ট ডিজিটাল খুলনা, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মানচিত্র প্রদর্শন, অংশগ্রহণমূলক ও সুশাসিত খুলনা, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস মিটিগেশন সেল স্থাপন, হটলাইন নগর তথ্য কেন্দ্র চালু, পরিকল্পনা প্রণয়নে পরামর্শক কমিটি গঠন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো, জলাশয় ও পুকুরগুলো সংরক্ষণ, শিশুদের সাঁতার শেখানোর বিশেষ উদ্যোগ, নগরীর বাজারগুলো আধুনিকায়ন, হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়িয়ে সেবার মান বৃদ্ধি, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে রাস্তার নামকরণ, বধ্যভূমিগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণ, যাতায়াত ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা প্রদান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ, ওয়াসা, কেডিএ, রেলওয়ে, টেলি কমিউনিকেশন ও বিদ্যুৎ পরিসেবা উন্নয়ন, কেসিসিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে বুলেটিন প্রকাশ এবং খুলনা মহানগরীর সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ।

সদ্য বিদায়ী এই মেয়র নগরবাসীকে অবহিত করার লক্ষ্যে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে-

১) জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নগরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও মাটির নিচের পানি সংরক্ষণে প্রাকৃতিক নদী, খাল ও জলাশয় সংরক্ষণ।

২) নগরবাসীর চিত্তবিনোদন ও পরিবেশ রক্ষায় পার্ক এবং উন্মুক্ত স্থানে খেলার মাঠ নির্মাণ।

৩) নগরীতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ। আশার কথা হচ্ছে ইতোমধ্যে কেসিসি ও কুয়েট কর্তৃক গৃহীত এসসিআইপি প্লাস্টিক প্রকল্পের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ণের কাজ চলমান আছে।

৪) প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ শিক্ষা, পুষ্টি ও ব্যবসা সহায়তা এবং স্যানিটেশন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম ভবিষ্যতেও চলমান রাখা হবে।

৫) নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সিটি সেন্টার, ওয়ার্ড অফিস কাম কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, কলেজিয়েট স্কুল, বাজার নির্মাণসহ কেসিসির বিভিন্ন স্থাপনার ছাদে ও পুকুরে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে।

৬) দূষিত পানি রিসাইক্লিং-এর মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে নগরভিত্তিক টেকসই পানিচক্র প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

৭) এডিবির অর্থায়নে নগরীর সকল স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি সিটি ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রস্তুত করা হবে। এর ফলে নগরীর সকল উন্নয়নমূলক কাজ সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

৮) দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় খুলনা স্মার্ট সিটি বেসিক প্ল্যান প্রস্তুত করা হবে, যা স্মার্ট শহর বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে।

৯) নকশায় প্রতিবন্ধীদের চলাচল উপযোগী র‍্যাম্প না থাকলে নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হবে না। এছাড়া নারী ও শিশুর জানমালের নিরাপত্তায় থানাগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে।

১০) খুলনার সঙ্গে নিকটবর্তী ও পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। রাস্তাগুলোকে সচল রাখতে ব্যাপক হারে কমিউনিটি পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হবে। চলাচলের জন্য বাইসাইকেলকে উৎসাহিত করা হবে। সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সব স্কুলে হেলথ প্রোগ্রাম চালু করা যাবে।

এছাড়া কর্মজীবী মায়েদের সুবিধার্থে পর্যায়ক্রমে থানাগুলোতে একটি করে আধুনিক ডে-কেয়ার সেন্টার কাম প্রি-স্কুল করা হবে। তরুণদের জন্য আধুনিক স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তৃতীয় লিঙ্গের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। খুলনা মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে লবণচরা, হরিণটানা ও আড়ংঘাটা এলাকায় স্থাপিত তিনটি নতুন থানা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

তিনি বলেন, খুলনা নগরভবন নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতীক। নগরীর প্রতিটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, উন্নয়ন, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, আনন্দ-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু সকল বিষয়ে নগর ভবন এবং নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের প্রত্যাশা আগামীতে নগরবাসীর সঙ্গে নগরভবনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং আমরাও সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাব।

তিনি আরও বলেন, পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হলে আমার আগের দায়িত্বকালের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার পাশাপাশি নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার জন্য সচেষ্ট থাকব।

ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও এস এম কামাল হোসেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পারভীন জাহান কল্পনা, খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ, কেসিসি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক কাজী আমিনুল হক, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুজিত কুমার অধিকারী, সাবেক সংসদ সদস্য মো. মিজানুর রহমান মিজান, আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম, শহিদুল হক মিন্টু, মুন্সী মাহাবুবুল আলম সোহাগ, অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম ও রুনু রেজা প্রমুখ।

মোহাম্মদ মিলন/আরকে