তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট এনায়েত শেখ (৩৪)। পরিবারের জন্য এক যুগ আগে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর আগে দেশে এসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর একবার দেশে এসেছিলেন গত ১৭ মাস আগে।

এরপর গত ছয় মাস আগে এক সন্তানের বাবা হন এনায়েত। তিনিই পছন্দ করে ছেলের নাম রাখেন ওসামা। তিনি বিদেশে থাকাকালীন জন্ম হয় ছেলের। ছেলের মুখ তার দেখা হয়নি। ঈদুল আজহার সময় দেশে ফিরে ছেলের মুখ দেখার স্বপ্ন ছিল এনায়েতের। 

সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল তার। চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যেতে হলো এনায়েতকে। গত শনিবার (১০ জুন) বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টার দিকে মালয়েশিয়ায় নিজ কর্মস্থলে তেলের ট্যাংকির ভেতর পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তার।

এনায়েত ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের বাংরাইল গ্রামের বাসিন্দা মৃত হামেদ শেখের ছেলে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তার বড় ভাই শাহাদাদ শেখ (৪০) সালথা উপজেলা পরিষদে চাকরি করেন। মেঝ ভাই ইবাদত শেখ (৩৬) থাকেন সৌদি আরবে। দুই বোনের মধ্যে বড় বোন হেলেনার বিয়ে হয়েছে সালথার বিনোকদিয়ায়, ছোট বোন কমেলার বিয়ে হয়েছে সালথার জুগিকান্দা গ্রামে।

তিন বছর আগে দেশে এসে পরিবারের পছন্দে সালথার ইউসুফ দিয়া গ্রামের মেয়ে রাইলী বেগমকে বিয়ে করে এনায়েত। ঈদুল আজহায় এনায়েত আসবে দেশে দেখা হবে ছেলের সাথে এ আনন্দে মশগুল ছিল পরিবারের সদস্যরা। শনিবার (১০ জুন) সকাল ৭টার দিকে কাজে বের হওয়ার আগে মালয়েশিয়া থেকে ইমোতে ভিডিও কলে এ কথা বলেন এনায়েত। কথা হয় মা ও স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রী কোলে নিয়ে ছেলেকে দেখান। এনায়েত স্ত্রীকে বলেন, 'আর তো মাত্র কয়েকদিন। কোরবানির ঈদের আগেই আসব, এসে সরাসরি ছেলেকে দেখবে, ওকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াব, মজা করব।'

ওই দিন ফোন ছাড়ার পরই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এনায়েতের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসই বলতে হয়। বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টার দিকে ওই দেশে থাকা এনায়েতের বাংলাদেশী সহকর্মীরা তার পরিবারকে ফোন করে জানায় এ খবর। সহকর্মীরা জানান, এনায়েত তেলের ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করার সময় ভেতরে পড়ে যান। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের ছোট ছেলের এ মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। এনায়েতের বড় ভাই শাহাদত শেখ (৩৯) বলেন, ১২ বছর আগে মালয়েশিয়ায় যায় এনায়েত। মালোশিয়ার জহুরবারো এলাকায় একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো ১০ জুন সকাল ৭টার দিকে ফোনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় তার। এটিই তার শেষ কথা ছিল।

তিনি আরও বলেন, এনায়েতের সঙ্গে একই কোম্পানিতে তার এক আত্মীয় হাসান শেখ কাজ করেন। হাসান জানিয়েছে কোম্পানি দেশে মরদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। ঢাকার শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে তাদের মরদেহটি গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এর জন্য সাত থেকে দশ দিন অপেক্ষা করতে হবে তাদের।

এনায়েতের বৃদ্ধা মা তছিরন বেগম (৬৬) ছেলের শোকে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ছেলেটা আমার বিদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে আমাদের মুখে হাঁসি ফুটিয়েছিল। সর্বশেষ সে ১৭ মাস আগে এসেছিল। বিদেশে থাকতেই ছেলের বাবা হয়। ছেলে হওয়ার পর প্রতিদিন ভিডিও কলে ছেলেকে দেখতো আর বলতো আগামী কোরবানির ঈদে এসে সরাসরি ছেলেকে দেখবে। কিন্তু ছেলেকে দেখার আগেই আমার বাজান চলে গেল। এটা আমরা কীভাবে মেনে নিব। এখন কি হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের।

সোনাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান বলেন, এনায়েত এলাকায় একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। গ্রাম্য কোনো দলাদলির মধ্যে এই পবিারের সদস্যরা থাকতো না। ছেলেটার মর্মান্তিক মৃত্যু হলো।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এনায়েত নিজের পরিবারের খেয়াল রাখার পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নেও ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতেন সামর্থ্য অনুযায়ী। মালয়েশিয়ায় থেকে উপার্জন করে গ্রামে ‘তানজিমুল উম্মাি মহিলা মাদ্রাসা ও নুরানী একাডেমি’ নামে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ওই মাদরাসায় বাংলা, অংক, ইংরেজি, আরবিসহ সব বিষয়ই পড়ানো হয়। চার নারীসহ শিক্ষক আছেন ছয়জন, শিক্ষার্থী আছে ৮৪ জন।

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন শাহিন বলেন, এনায়েতের মৃত্যুর ঘটনা আসলেই মর্মান্তিক। পরিবারের সদস্যদের স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। তার মরদেহ দেশে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।

জহির হোসেন/আরকে