বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কে নির্মিত হচ্ছে দুইটি ফুটওভার ব্রিজ। একটি বাগেরহাট জেলা দায়রা জজ আদালত ও অপরটি ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রধান ফটকের পাশে।

সড়ক বিভাগের বাস্তবায়নে এই ফুটওভার ব্রিজ দুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকা। তবে নির্মাণাধীন স্থানে এই ফুটওভার ব্রিজের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে দাবি স্থানীয়দের।

বাগেরহাট সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যানজট নিরসন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পারাপারের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ খাতের অর্থায়নে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিট বেজ স্টিলের স্ট্রাকচারে নির্মিত হচ্ছে এই দুটি ফুটওভার ব্রিজ।

অপরদিকে ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রত্ন আইনও মানা হয়নি বলে জানা যায়। ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাটের অন্যতম দুটি নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সিঙ্গাইর মসজিদের মাঝ দিয়ে গেছে সড়কটি। প্রতিনিয়ত ভারী যানবাহনের কারণে কম্পনে ক্ষতি হচ্ছে এই বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থাপনা দুটি। এজন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও ঐতিহ্য সচেতনরা বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণে সড়কটি স্থাপনার পাশ থেকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় সড়কটি না সরিয়ে সেখানেই তৈরি করা হচ্ছে একটি ফুটওভার ব্রিজ।

কাজটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড’। গত ১৭ এপ্রিল নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয় এবং ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। ২০ ফুট উচ্চতা ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রতিটি ব্রিজে চারটি করে সিঁড়ি থাকবে।

নির্মাণাধীন এলাকায় দেখা যায়, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গাছ কাটা হয়েছে। খোঁড়া হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় গর্ত, শুরু হয়েছে বেজ ঢালাই। একপাশে কিছু ইট, পাথর, বালু ও সিমেন্ট জড়ো করে রাখা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজনীয় অনেক কাজ বাকি থাকলেও তা না করে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ পরিকল্পনাকে বিলাসিতা হিসেবেই দেখছেন সাধারণ মানুষ। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আধুনিক শহর এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলে ফুটওভার ব্রিজ বানানো হচ্ছে। অথচ এখান দিয়ে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, অন্তঃসত্ত্বা নারী কীভাবে পার হবেন তার ব্যবস্থা নেই। অবস্থা হয়েছে ‘সরকারের মাল, দরিয়ায় ঢাল’।

আদালতে সেবা নিতে আসা বৃদ্ধ আব্বাস  ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এখানে আসি। কখনও তেমন দুর্ঘটনা চোখে পড়েনি। কিছুদিন ধরে শুনতেছি, এখানে উপরে হাঁটার রাস্তা হবে। আমি বাবা, আস্তে করে রাস্তা দিয়েই পার হব। অত উঁচুতে উঠে কে পার হবে!

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এগুলো নির্মাণ শেষে রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার না হলেও সন্ধ্যায় আড্ডা আর রাতে মাদকের আখড়া হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পাবে।

তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি করতে হলে প্রকল্পের প্রয়োজন, সেই প্রকল্প জনগণের জন্য কতটুক প্রয়োজন সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ৬ কোটি টাকার ফুটওভার ব্রিজ ৯০ ভাগ লোকের কাজে আসবে না। প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে জনমত যাচাই করা উচিত ছিল। এটি সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

কাজী ইয়াসিন নামের এক আইনজীবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফকিরহাটের নোয়াপাড়া থেকে মোল্লাহাট ব্রিজ পর্যন্ত মহাসড়কটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। সেখানে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। ওই ৬ কোটি টাকা দিয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা উচিত।

ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বাগেরহাট শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরের বেশির ভাগ রাস্তা ভাঙাচোরা। গ্রামগঞ্জে মানুষ সেতুর অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাঁকো দিয়ে খাল পার হয়। অথচ যে দুই জায়গায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে, সেটি দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক না। আর এই সড়ক পার হতে মানুষ দুই তলায়ও উঠবে না। ট্র্যাফিক পুলিশ, স্পিডব্রেকার, আর জেব্রা ক্রসিং দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে সড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা আসলে কোনো কাজে আসবে না। আমরা তো চাকরি করি, কিছু বলতে পারব না। এই রাস্তা চার লেন হবে, এই সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হলে দুই লেনের সড়কে করা এই ফুটওভার ব্রিজের উপযোগিতা থাকবে না।

এ বিষয়ে সড়ক বিভাগ, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটারের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হবে।

এমজেইউ