নানা সংকটে এক মাস বন্ধ থাকা নীলফামারীর সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি ফের চালুর ৫ দিনের মাথায় এর বাউন্ডারি ওয়াল ও তালা ভেঙে জেনারেটর চুরির ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার (১৬ জুন) দিবাগত রাতের যেকোনো সময় এ ঘটনা ঘটে।

শনিবার (১৭ জুন) সকালে বাউন্ডারি ওয়াল ও জেনারেটর রুমের তালা অবস্থায় দেখতে পান হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী মারুফ হোসেন। তাৎক্ষণিক ঘটনাটি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মান্না চক্রবর্তীকে জানান।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মান্না চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সাময়িক অসুবিধার জন্য হাসপাতালে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে। সকাল ৮টার দিকে হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী মারুফ হোসেন আমাকে মোবাইলে জানান যে, হাসপাতাল ভবনের পেছনে জেনারেটর রুম থেকে রাতের বেলা কে বা কারা তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে জেনারেটরটি চুরি করে নিয়ে গেছে। নিরাপত্তা রক্ষী আরও জানায় সর্বশেষ রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালের সব দিক রাউন্ড দিয়ে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তখন জেনারেটরটি ছিল। সকালে উঠে দেখি জেনারেটরটি নেই। আমি খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে দেখতে পাই জেনারেটর রুমের তালা ভাঙা ও জেনারেটরটি নেই।

তালা ভেঙে চুরি করা হয়েছে জেনারেটর

তিনি বলেন, আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই চুরির সঙ্গে হাসপাতাল বিরোধীরাও জড়িত থাকতে পারে। আমি এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে সৈয়দপুর থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছি।

হাসপাতালের পরিচালক রাকিবুল ইসলাম তুহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালটি সঠিকভাবে পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে এই চুরির ঘটানো হয়েছে।

সৈয়দপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। জেনারেটরটি উদ্ধারে চেষ্টা চলছে।

এর আগে হাসপাতালটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পরিচালনা কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা সমস্যায় ধুঁকে ধুঁকে চলার পর গত ৮ মে দুপুরে হাসপাতালটির পুরো কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন হাসপাতালের অস্থায়ী আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মান্না চক্রবর্তী।

হাসপাতালটি এক মাস ধরে বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০০ গোদ রোগী। প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিতে আসা ৮ থেকে ১০ জন রোগী চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে গত ৮ জুন জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ‘এক মাস ধরে বন্ধ বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, বিপাকে রোগীরা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর দ্রুত হাসপাতালটি চালুর বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাধিকবার আলোচনায় বসেন হাসপাতালটির পরিচালক রাকিবুল ইসলাম তুহিন। আলোচনা সভায় সকল সমস্যা সমাধান করে হাসপাতালটি চালুর সিদ্ধান্ত নেন।

পরে গত ১২ জুন হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য কার্যক্রম ফের চালু হয়। প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর হাসপাতালটি চালু হওয়ায় গোদ রোগী ও স্বজনদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।

প্রসঙ্গত, উত্তরের জেলা নীলফামারীসহ ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় ফাইলেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগের চিকিৎসার জন্য ২০০২ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ এলাকায় ৭৫ শতক জায়গায় যাত্রা শুরু করে ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইম্যুনোলজি অব বাংলাদেশ (আইএসিআইবি) হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিল। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রকল্প পরিচালক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন ওই সময় স্থানীয়ভাবে ১৮ জন দেশি-বিদেশি চিকিৎসককে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। জাপান, কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় দুটি বহুতল ভবন নিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকেও গবেষণা কর্মীরা আসেন এখানে। তবে ২০১২ সালে হাসপাতালটিকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে সংকট সৃষ্টি হয়। পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বে ভেঙে পড়ে সেবা কার্যক্রম। মুখ ফিরিয়ে নেয় দাতা সংস্থাগুলো। এরপর থেকে ধুঁকে ধুঁকে চলছিল হাসপাতালটি।

২০২১ সালের ৩ অক্টোবর সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে টোকেন মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার প্রত্যয়ে সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাব নামে নতুন করে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা লেপরার সঙ্গে বাংলাদেশ প্যারামেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক সব ধরনের সহযোগিতা করবে লেপরা বাংলাদেশ। এর দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ প্যারামেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রাকিবুল ইসলাম তুহিন। এরপর বিভিন্ন জেলা থেকে নতুন করে প্রায় ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়।

শরিফুল ইসলাম/আরকে