পাঁচ বছর আগে সাত একর পতিত জমিতে একটি শেড বানিয়ে ৫০টা গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করেন  শিহাব উদ্দিন শাহিন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন প্রতি বছর ২০০ গরু বিক্রি করেন তিনি। সেই খামার থেকে এবার কোরবানির ঈদে ২০০ গরু বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন তিনি । যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।

শিহাব উদ্দিন শাহিন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। মানফাত মিট ক্যাটেল অ্যান্ড ডেইরি ফার্ম নামের তার খামারটি এখন বৃহত্তর নোয়াখালীর বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাচ্ছে। তার সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন নতুন খামারিরা। 

নোয়াখালীর সদর উপজেলার শুল্লুকিয়া ইউনিয়নের চর উড়িয়ার খলিলের দরজা এলাকার ওই খামারটি দৃষ্টি কাড়ছে সবার। পুরো খামারটিতে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। শেডের ভেতরে প্রতিটি গরুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চা। রয়েছে গরুর গোসল, চিকিৎসা ও প্রজননের জন্য আলাদা ব্যবস্থা।

পৈতৃক ব্যবসার সূত্র ধরে খামারটি তৈরি করেছেন শিহাব উদ্দিন শাহিন। এটি বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের গরু মোটাতাজাকরণের সবচেয়ে বড় খামার বলে দাবি করা হচ্ছে। 

জানা যায়, গরু মোটাতাজা ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য ৮০টি শাহিওয়াল ও ফ্রিজিয়ান জাতের গরু দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মানফাত মিট ক্যাটেল অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের। এখানে বড় গরু থেকে শুরু করে ছোট ছোট গরুও রয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন গমের ভুসি, মুগডাল ভুসি, মসুর ভুসি, সয়াবিন খৈল, কাঁচা ঘাস, খড় ও লবণ ছাড়াও দেশীয় বিভিন্ন দানাদার খাবার দেওয়া হয় গরুকে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই গরুর খামার এটি। ভেতরে সাজানো গোছানো। সারিবদ্ধ গাভি ও ষাঁড় খাবার খাচ্ছে। তিনটি শেডে এ বছর গরু রয়েছে দুই শতাধিক। এসব গরু লালন-পালনে কাজ করছেন আটজন শ্রমিক। খামারের প্রথম শেডে রয়েছে গাভি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শেডে রয়েছে মোটাতাজাকরণ গরু।

কর্মরত শ্রমিক আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আটজন কর্মচারী গরুগুলোর যত্ন নিই। সপ্তাহে দুই দিন ব্লিসিং পাউডার ও চুন দিয়ে খামার পরিষ্কার করে রাখি। শুধু গরু কেনার জন্য নয়, অনেকেই শখ করে খামার দেখতে আসেন। মশা-মাছি বা কোনো রকমের দুর্গন্ধ নেই খামারে। সুন্দর পরিবেশ আর আধুনিক উপায়ে গরু পালন করি আমরা।

খামারের মালিক শিহাব উদ্দিন শাহিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার আগ থেকেই আমাদের পরিবার কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আমাদের আগে বাথান ছিল, যা এখানো আছে। বর্তমানে বাথানে দেশীয় গরু, মহিষ ও ভেড়া রয়েছে। দীর্ঘদিন আমাদের দুধের গাভি ছিল। আমি সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমাদের পতিত জায়গায় বছরে একবার ধান চাষ হতো আর সারা বছর পড়ে থাকত। এর বহুমুখী ব্যবহার করার জন্য আমি খামার শুরু করেছি। গরুর পাশাপাশি মাছ ও পোলট্রির খামার রয়েছে এখানে। ঈদুল আজহাসহ সারা বছরে এ অঞ্চলের মানুষকে পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত গরুর মাংস দিতে খামারটি করেছি।

তিনি আরও বলেন, খামারের বয়স পাঁচ বছর চলছে। যদি ঈদুল আজহা উপলক্ষে মানুষকে সুস্থ, সবল ও সুঠাম দেহের গরু দিতে পারি, তাহলে তাদের মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি আমিও সওয়াবের অধিকারী হবো। আমি খুব লাভের চিন্তা করি না। কেননা আমিও এই সমাজের একজন। মানুষ যদি কোরবানির সময় প্রতারিত না হয়ে ভালো গরু পায়, তাহলে সবাই কমবেশি উপকৃত হবে। আমার দেখাদেখি জেলায় অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

শিহাব উদ্দিন শাহিন বলেন, নোয়াখালীতে প্রথম আমি লাইভ ওয়েট স্কেলে গরু বিক্রি শুরু করি, পরে আমার দেখাদেখি অন্যরাও শুরু করেছে। আমি মনে করি বাজারে গেলে মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। কোরবানির হাটে দালাল থাকে, তারা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। খামারে এলে পছন্দের গরু লাইভ ওয়েট স্কেলে কিনতে পারে। আমরা শতভাগ সুষ্ঠু ও সুঠাম দেহের গরু দিয়ে থাকি। 

শাহিনের খামারের গরুগুলোকে  প্রতিদিন একবার বা দুবার গোসল করানো হয়। দুর্গন্ধমুক্ত রাখা হয়। এখানে ঘাস চাষ করেছেন তিনি। যা দিয়ে গরুগুলোর ঘাসের চাহিদা পূরণ হয়। পাশাপাশি খড়, ভুসি, পোলট্রি ফিড ব্যবহার করা হয়।

তিনি বলেন, আমি ৭০টা গরু দিয়ে শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে ১২টি দুধের গরু ছিল। বর্তমানে ২৫০টি গরু রয়েছে। আমার বাবার জমি হওয়ায় কোনো ভাড়া দিতে হয় না। বড় গরু থেকে শুরু করে ছোট ছোট গরুও রয়েছে। সব গরুকে দেশিও খাবারের মাধ্যমে লালন-পালন করা হয়েছে। বর্তমানে গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় আমাদের সামগ্রিক খরচ বেড়ে গেছে।

জেলা শহর মাইজদী থেকে খামারে কোরবানির গরু দেখতে আসা জাভেদ মির্জা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই খামারটি নোয়াখালীর অন্যতম খামার। এটার সুনাম রয়েছে। আমরা প্রতি বছর এখান থেকে গরু নিয়ে থাকি। পছন্দের গরু বুকিং দিয়ে গেলে ঈদের দিন সকালে তারা পৌঁছে দেয়। এতে করে গরু দেখভাল ও রাখার জায়গা নিয়ে আলাদা চিন্তা করতে হয় না।

খামারে গরু দেখতে আসা নিশান নামে আরেক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলাম এবং খামারের পরিবেশ দেখলাম। অনেক খামার দেখেছি কিন্তু এই খামারের মতো না। কোরবানির গরু কিনলে এখানে নিরাপদে থাকে। বাহির থেকে নিলে গরু রাখা নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয়।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কাজী রফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিহাব উদ্দিন শাহিনের খামারটি অনেক বড়। সবচেয়ে বড় খামারের বিষয়টি আপেক্ষিক। তবে গরু মোটাতাজাকরণে এত বিশাল খামার নোয়াখালীতে আর একটিও নেই। গরুর খাদ্য, চিকিৎসা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হয়। আমি নোয়াখালীতে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই খামারের নানা দিক নিয়ে পরামর্শ দিয়ে আসছি। আমার বিশ্বাস নোয়াখালীতে যত খামার রয়েছে সেগুলোতে প্রাকৃতিক উপায়ে গরু লালন-পালন করা হয়। কোনো ধরনের হরমোন এবং অখাদ্য কুখাদ্য ব্যবহার করা হয় না।

হাসিব আল আমিন/আরএআর