ফাইল ছবি

ফলের বাগানে কাজ করতে হবে। খাটুনি কম, কিন্তু বেতন বেশি। চাকরি হবে তিনজনেরই। এমন প্রলোভনে পড়ে মা তার তিন সন্তানকে নিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই ছুটে যান ভারতে। চাকরি তো জোটেইনি সেখানকার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তাদের ঠিকানা এখন মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই জেলা কারাগার। তারা টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপ‌জেলার প্রত‌্যন্ত চরাঞ্চল গাবসারা ইউনিয়‌নে‌র রামপুর গ্রা‌মের বা‌সিন্দা । 

চলতি বছরের মার্চ মাসে কারাগার থেকে এক কর্মকর্তার সহায়তায় মেয়ের করা ফোনে খবরটি জানতে পারেন বাবা। তার স্ত্রী, ২৩ ও ১৬ বছর বয়সী দুই মেয়ে এবং ১৩ বছরের ছেলেকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে ৯ মাসের কারাদণ্ড দেয় সেখানকার আদালত। টেলিফোনে মেয়ে জানান, মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন তারা। 

তবে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া জটিল বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার।

জানা গেছে, হতদরিদ্র সুজা মিয়ার (ছদ্মনাম) ছোট মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করার সুবাদে সিলেট জেলার বাসিন্দা মানবপাচারকারী হিসেবে অভিযুক্ত স্বপন ও মেসবা উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তারা মাসহ দুই বোনকে ভারতের কাশ্মীরে একটি ফল বাগানে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখায়। দালালদের কথা মতো গত বছর রোজার ঈদের সপ্তাহখানেক আগে বাড়ি থেকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এরপর একদিন রাতে ভারতের উদ্দেশ্যে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সিলেটে যাওয়ার সময় স্বামী সুজা মিয়ার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় স্ত্রীর। ওটাই তাদের শেষ কথা। এরপর স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। 

এক বছর পর চলতি বছরের মার্চে ভারতের জাওয়াই জেলা কারাগার থেকে এক কর্মকর্তার ফোন থেকে মেয়ে বাবাকে জানায়- তারা কারাগারে আছেন। দালালরা পাসপোর্ট ছাড়াই সিলেট অঞ্চলের একটি বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করে তাদের। তিন মাস পার হয়েছে সাজার মেয়াদ। এখন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় তারা জেলহাজতেই রয়েছে। তারা দেশে আসার আকুতি জানিয়েছেন স্বজনদের কাছে।

এদিকে স্ত্রী সন্তানদের হারিয়ে পাগল প্রায় সুজা মিয়া। পড়ালেখা না জানা হতদরিদ্র সুজা মিয়া নদীতে নৌকা চালিয়ে সংসার চালান। স্ত্রী-সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্নজনের কাছে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। কোথায় গেলে তার পরিবারের সদস্যদের দেশে ফেরত আনতে পারবেন সেটাও তিনি জানেন না।

মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই জেলা কারাগারে আটককৃতরা মোবাইলে জানান, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে স্বপন ও মেসবা মিলে তাদের ভারতে পাচার করেছিল। তারা তাদের বিক্রি করার উদ্দেশ্যে ভারতে পাচার করে। ভারতে যাওয়ার পর দালালরা একটি এলাকায় রাখে তাদের। কয়েকদিন পর সেখানকার লোকজন পুলিশে ধরিয়ে দেয়। এরপর সেখানকার আদালত ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে ৯ মাসের কারাদণ্ড দিয়ে জোয়াই জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে সেখানেই চারজন কারাভোগ করছে। সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে আরও তিন মাস অতিবাহিত হচ্ছে।

তারা আরও জানান, সাজার মেয়াদ শেষ হলেও তাদের ছাড়া হচ্ছে না পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায়। কোনো তথ্য না থাকায় প্রমাণ করতে পারছেন না তারা বাংলাদেশি। এছাড়া ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য। হাইকমিশনও বলছে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। হাইকমিশন থেকে উদ্যোগ না নেওয়া হলে তাদের রিফিউজি (শরণার্থী) হিসেবে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সুজা মিয়া বলেন, আমি গরিব লেখাপড়া জানি না। বছর খানেক আগে ঈদের আগে শিশু সন্তান ও দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী ঢাকায় চলে যায়। এরপর তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। পরে খোঁজাখুঁজির দুই মাস পর ভূঞাপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করি। যদিও থানা থেকে তখন কোনো কাগজ দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ সময় পর স্ত্রী ফোন করে জানায় তারা ভারতে জেলে রয়েছে। তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে কাজের আশায় ভারতে গিয়েছিল। তারা ফিরতে চায় কিন্তু ভারতের পুলিশ বাংলাদেশে তাদের পাঠাচ্ছে না। আমি স্ত্রী, মেয়ে ও সন্তানদের ফেরত চাই।

মোবাইলের হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে ওই কর্মকর্তা সুজা মিয়াকে জানান, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও শিশু সন্তান বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ফলে ভারতের আদালত তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে ৯ মাসের জন্য কারাগারে প্রেরণ করেছে। কারাগার কর্তৃপক্ষ কেবল ভ্রমণের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে যাতে তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে। ইতোমধ্যে গুয়াহাটির বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে তাদের মুক্তি সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু কমিশন কিছুতেই সাড়া দেয় না। বরং হাইকমিশন অফিস থেকে বিলম্ব করছে। যদি হাইকমিশনার ভ্রমণের অনুমতি পাঠান তাহলে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।

ভূঞাপুর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ও গাবসারা ইউনিয়ন বিট কর্মকর্তা মো. লিটন মিয়া বলেন, হারানো বা নিখোঁজের বিষয়ে থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি হয়নি।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সেক্টর স্পেশালিস্ট (কেইস ম্যানেজমেন্ট) এম রায়হান কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম কাজ শুরু করেছে মা, দুই মেয়ে ও শিশু সন্তানকে দেশে ফেরত আনার জন্য। তারা বর্তমানে মেঘালয় রাজ্যের জোয়াই জেলা কারাগারে রয়েছেন। ইতোমধ্যে ভারতের হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুতই তারা দেশে ফেরত আসবে।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তারা যদি সুস্পষ্টভাবে বলে কীভাবে অপরাধটি সংগঠিত হয়েছে, সেটা যদি আইনের আওতায় আসে, আইনে যদি পড়ে, তাহলে আমরা মামলা রুজু করে তাদেরকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করবো। মানবপাচারের এ ঘটনা জেলায় প্রথম। এর আগে এমন কোনো ঘটনার খবর বা কোনো অভিযোগ পাইনি।

তিনি আরও বলেন, তবে পাসপোর্ট ছাড়া কেউ বিদেশে আটক হয়ে জেলহাজতে থাকলে তাদের ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট ছাড়া তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করাটা কঠিন। পাসপোর্ট ছাড়া তারা সেদেশে অবৈধ পথে অনুপ্রবেশ করেছে বিধায় সেখানে পুলিশ তাদের আটক করে আদালতে সোপর্দ করেছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু করার নেই। 

আরএআর