এক সময় যে হাতে ছিল সংবাদপত্র। যা সরবারাহ করতে হতো অফিসে-দোকানে। বর্তমানে সে হাতে উঠেছে কলম খাতা। সে বর্তমানে পরকোট দশঘরিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ব্যবসা শিক্ষা বিভাগের ছাত্র।

বলছিলাম নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পরকোট ইউনিয়নের পূর্বশোশালিয়া গ্রামের আব্দুল কাদের লালনের ছেলে আবু সালেহ মাহির (১৫) কথা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) চেষ্টায় পাল্টে গেছে তার হকার জীবন। 

জানা যায়, ২০১৮ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান মাহির মা মানছুরা বেগম। মায়ের মৃত্যুর পর তার জীবনে সব এলোমেলো হয়ে যায়।  স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন মাহির বাবা আব্দুল কাদের লালন। ২০১৯ সালে এক দুর্ঘটনায় মাহির বাবা ঘরবন্দী হয়ে পড়েন। ২০২০ সালের করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে অভাবের তাড়নায় মাহিকে টাইলসের কাজে দেন আব্দুল কাদের লালন। সেখানে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যুক্ত হন পত্রিকার হকারের পেশায়। একদিন পত্রিকা দিতে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়া তার পেশা সম্পর্কে জানতে চান।

পড়াশোনার ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে মাহি বলে, আমারও ইচ্ছে করে বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কিন্তু বাবার আয় নেই, আমার আয় দিয়েই সংসার চলে। তারপর মাহির সংসার ও পড়াশোনার দায়িত্ব নেন চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়া। 

আবু সালেহ মাহি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা নেই। বাবা নিরুপায় হয়ে আমাকে কাজে দিয়েছেন। আমি প্রতিদিন পত্রিকা দিতে ইউএনও স্যারের অফিসে যেতাম। ইউএনও স্যারের মনে দয়া হয়েছে। তাই আমার পড়াশোনা ও সংসারের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। স্যারের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই, বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। 

মাহির বাবা আব্দুল কাদের লালন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখনো ঋণের মধ্যে আছি। এক দুর্ঘটনায় আমিও অসুস্থ হয়ে যাই। নিজে শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারি না। ইউএনও স্যার অনেক ভালো মানুষ। বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতি আমার যে দায়িত্ব ছিল তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন। আমি স্যারের কাছে চির ঋণী। আমার ছেলে যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে সেজন্য দোয়া চাই। আল্লাহ যেন ইউএনও স্যারকে ভালো রাখে সেই দোয়াও করি। আসলে উনার মতো মানুষ হয় না। উনি অনেক ভালো মানুষ। 
 
বর্তমানে পরকোট দশঘরিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আল বাকের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২২ সালে ইউএনও স্যার আমাকে ফোন দিলে আমি উনার অফিসে গিয়ে কথা বলি। মাহির পড়াশোনার বিষয়ে জানালে আমি সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করি। স্কুলের পক্ষ থেকে তার সকল বেতন এবং পরীক্ষা ফী মওকুফ করে দেই। মাহির ভেতরে আগ্রহ আছে। আশা করি সে ভালোভাবে পড়াশোনা করে ইউএনও মহোদয়ের উদ্যোগকে সফল করবে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি সব সময় মাহির পাশে রয়েছি। 

চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চাটখিল উপজেলায় যোগদানের পর থেকেই দেখতে পেতাম মাহি নামের ছোট্ট ছেলে আমাকে পত্রিকা দিতে আসতো। সে এখানকার প্রেসক্লাবের হকার ছিল। এক দুই দিন আসার পর ছেলেটার চোখে আমি মেধা ও সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি। আমি তার থেকে খবর নেই জানতে পারি তার বাবা শারিরীক ভাবে অক্ষম ফলে তার আয় দিয়েই সংসার চলে। তারপর তার স্কুলের শিক্ষকের সাথে কথা বলে পড়ার ব্যবস্থা করে দেই। মাহির বাবা জানায় মাহির বেতনের টাকায় তাদের সংসার চলে। আমি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে তাকে মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে দেই। অনেকেই মাহিকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বছরের শুরুতে একটি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে স্কুলের ব্যাগ, জুতো, বইয়ের ব্যবস্থা করি। বর্তমানে তাকে চার হাজার টাকা করে দেই।

মাহির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মুহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়া আরও বলেন, মাহির জীবনে এটা একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল এখন আবার শুরু করেছে। আমার ইচ্ছে মাহি পড়াশোনা করুক, যেন জীবনে কিছু করতে পারে। পড়াশোনা করলে চাকরি হতে পারে অথবা অন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এতে করে একটা সংসার এগিয়ে গেলে দেশটা আগাবে। আমি যতদিন এই উপজেলায় আছি মাহির পাশে আছি। আমি চলে গেলেও মাহির পড়াশোনা যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাব। 

বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ইউএন বলেন, মাহি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমাদের আশপাশে অনেক মাহি আছেন যারা একটু সুযোগের অভাবে পড়াশোনা করতে পারছেন না। বিত্তবান যারা আছেন তারা যদি এসব মাহির পাশে সহানুভূতি নিয়ে তাকাই তাহলে অনেকের জীবন বদলে যেতে পারে। এতে খুব বেশি খরচ হবে না কিন্তু শিক্ষার মতো একটি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। 

নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন প্রজন্মের যারা ইউএনও  হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষ। তাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিল অথবা নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। অর্থাৎ এই ডিজিটালের যুগে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির মানুষগুলো প্রশাসনে আছে বলে আমি মনে করি। তাদের সবার বয়স খুবই কম, কারো বয়স ৪০ পার হয়নি। তারা পড়াশোনা করেই এখানে এসেছে। তার ভেতরে মানবিকতা মূল্যবোধ আছে বলেই তারা এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। আসলে মন থেকে না এলে এমন কাজ করা যায় না। তিনি আমাকে বিষয়টি শেয়ার করেছেন আমি বলেছি আপনি যেখানে ঠেকে যাবেন আমাকে জানাবেন। আমি সার্বিক সহযোগিতা করব। 

হাসিব আল আমিন/আরকে