২১ বছর পর ভারত থেকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরলেন মতিউর
দীর্ঘ একুশ বছর পর ভারত থেকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরলেন মতিউর রহমান (৩৬)। শুক্রবার (২১ জুলাই) দেশের চারদেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরেন তিনি।
এদিকে ছেলেকে ফিরে পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দে কাঁদতে থাকেন বাবা শহিদুল ইসলাম, মা মর্জিনা বেগম, ছোট বোন সাইফুন্নাহারসহ স্বজনরা।
বিজ্ঞাপন
মর্জিনা বেগম ছেলেকে বুকে টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে একুশ বছর পর পেয়েছি। বুকের ধন ফিরে এসেছে। আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্যে কেঁদেছিলাম, আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন।’
মতিউরের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সন্তান হারানোর কষ্ট যে কত কঠিন তা সবাই বুঝতে পারবে না। আমার পরিবার সেই কষ্ট বুঝেছে। দীর্ঘ একুশ বছর বুকের মধ্যে কষ্টের পাথর বেঁধে রেখেছিলাম। আজ ছেলেকে যারা ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
বিজ্ঞাপন
এর আগে সকাল ৯টা থেকেই বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্টে বৃষ্টির মধ্যে ছেলের আসার অপেক্ষা করতে থাকেন মা-বাবাসহ স্বজনরা। দুপুর আড়াইটার দিকে ফুলবাড়ী ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করে বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি আইসিপি পয়েন্টে মতিউর রহমানকে নিয়ে আসেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা এবং সহযোগী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বরালি কে কোন্ডউইলিকার। তারা মতিউর রহমানকে বিজিবি ও ইমিগ্রেশনের এএসআই খায়রুল ইসলামের মাধ্যমে পরিবারের কাছে তুলে দেন।
পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা বলেন, আমরা ২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার এক রাস্তা থেকে মতিউরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করি। আমরা মানসিকভাবে যারা বিপর্যস্ত, যারা রাস্তায় থাকেন তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করে থাকি। মতিউর রহমানকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমরা অনেক খুশি।
পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের সহযোগী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. স্বরালি কে কোন্ডউইলিকার বলেন, আমরা মতিউরকে অসুস্থ অবস্থায় পেয়েছিলাম। তার রোগটি খুবই জটিল। এ রোগটি সম্পর্কে অনেকে জানে না। অনেক জায়গায় এ রোগের চিকিৎসা নেই। এ কারণে এ রোগে আক্রান্তরা বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়। এ রোগের অবশ্যই চিকিৎসা আছে। তাই আমরা যতটা পারি উদ্বুদ্ধ করি। মতিউরকে সুস্থ করে তার পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরে নিজেদেরকে সার্থক মনে করছি।
পুলিশের এএসআই খায়রুল ইসলাম বলেন, মতিউর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছিলেন। তিনি আজ ভারত-বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও এনজিওর মাধ্যমে দেশে ফিরেছেন। আমরা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।
দেশে ফিরে মতিউর রহমান অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ভারতে ছিলাম। ভাবতে পারিনি মা-বাবার কাছে আসতে পারব। যারা আমাকে দেশে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
মতিউরের ছোট বোন সাইফুন্নাহার বলেন, আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ভাইকে হারিয়েছি। এত বছর পর ভাইকে ফিরে পেয়ে কি যে আনন্দ হচ্ছে তা প্রকাশ করার মতো নয়। ভাইকে ফিরে পেতে ঠাকুরগাঁও থেকে বাংলাবান্ধায় ছুটে এসেছি।
ঠাকুরগাঁও সদর থানার আখানগরের ইউপি চেয়ারম্যান রোমান বাদশা বলেন, ২১ বছর আগে আমার ইউনিয়নের শহিদুল ইসলামের বড় ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর পর সে ভারত থেকে বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। খবর পেয়ে তার পরিবারকে নিয়ে মতিউরকে নিতে ছুটে এসেছি। সত্যিই আনন্দ লাগছে।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে হারিয়ে যান মতিউর। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার আখানগর ইউনিয়নের ঝারগাঁও গ্রামের সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগমের বড় ছেলে। হারিয়ে যাওয়ার পর ঠাকুরগাঁও সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন মতিউরের বাবা সহিদুল ইসলাম।
২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার এক রাস্তা থেকে মতিউরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। সংগঠনটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বিশেষ করে যারা রাস্তায় থাকেন তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করে। মতিউরকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তাকে সম্ভাব্য সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করেন। চিকিৎসার একপর্যায়ে চিকিৎসকরা জানতে পারেন, তার বাড়ি বাংলাদেশে। ওই সময় মহামারি করোনা শুরু হলে মতিউরের পরিবার সন্ধানের বিষয়টি স্থবির হয়ে পড়ে।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আহমেদাবাদের বেসরকারি সংস্থা ‘স্নেহালয়’ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়। মতিউরকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের রাহা নবকুমার ও তার স্ত্রী তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতিশ শর্মা। রাহা নবকুমার ও তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একসময় ঠাকুরগাঁওয়ে মতিউরের স্বজনদের খুঁজে বের করে গত ২৭ জুন মতিউরকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
এসকে দোয়েল/এমজেইউ