সাতক্ষীরার রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি থেকে। তবে এখন চিংড়ি চাষিদের মাথায় হাত। করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পানে সর্বস্বান্ত চিংড়ি চাষিরা। গত ১০ বছরে এমন বিপর্যয় দেখেননি তারা।

করোনায় জেলার চিংড়ি চাষিদের ক্ষতি হয়েছে ৩৩৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আম্পানে মাছ ভেসে ক্ষতি হয়েছে ১৭৭ কোটি টাকা। এবার অনেকেই ঘেরে মাছ ছাড়তে পারেননি। পোনার দাম কম হলেও কেনার টাকা নেই অনেকের। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন কিনা জানেন না চিংড়ি চাষিরা।

মৎস্য অধিদফতর বলছে, করোনায় চাহিদা কমেছে চিংড়ির। কমেছে দাম। বেড়েছে মাছের খাবারের দাম। এ অবস্থায় ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা।

সাতক্ষীরার রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি থেকে

দেবহাটা উপজেলার বদরতলা এলাকায় ১২৪ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির ঘের দিয়েছেন ওবায়দুর রহমান। করোনায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তার। এখন তিনি পুঁজিহারা। 

ওবায়দুর রহমান বলেন, করোনার কারণে চিংড়ি রফতানি বন্ধ। উৎপাদন কম হওয়ায় দেশের বাজারে মাছগুলো চলে যায়। দাম ছিল অনেক কম। ২০২০ সালে এক হাজার চিংড়ি মাছের পোনা কিনেছিলাম ৯০০-১০০০ টাকায়। ২০২১ সালে এখন চিংড়ি পোনার দাম অনেক কম। তবু টাকার অভাবে কিনতে পারিনি। সরকারিভাবে এইচপিএফ চিংড়ির পোনা বাজারে দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বাজারে আসছে চট্টগ্রামের এমকে হ্যাচারির পোনা। সরকারি কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে তদারকি করেন না।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হ্যাচারি মালিকদের প্রণোদনা দিয়েছেন। তবে আমার মতো চাষিরা প্রণোদনা পাননি। যারা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার টাকা লোন নিয়েছেন তারা পেয়েছেন প্রণোদনা। বাগদা চিংড়ি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারকে এটি নিয়ে ভাবতে হবে। তা না হলে বাগদা চিংড়ির ঘের ধ্বংস হয়ে যাবে।

১২৪ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির ঘের দিয়েছেন ওবায়দুর রহমান, করোনায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে তার

পাইকগাছা থানার চাঁদখালি এলাকায় ৩০০ বিঘা ঘেরের মালিক আব্দুল আলীম গাজী। তিনি বলেন, আম্পানে মাছের ঘেরের বাঁধ ভেঙে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে আবার ঘেরে মাছের পোনা ছেড়েছি। উৎপাদন ভালো হলে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব। তা না হলে শেষ।

আশাশুনি উপজেলার কাপসান্ডা এলাকায় ১২৯ বিঘা চিংড়ি ঘেরের মালিক মনিরুজ্জামান বলেন, গত বছর মাছের পোনার দাম বেশি ছিল। প্রতি হাজার পোনার দাম ছিল ৮০০-১০০০ টাকা। তবে এ বছর মাছের পোনার দাম ১৫০-২০০ টাকা। পোনার দাম কম হওয়ায় ঘের ব্যবসায়ীরা খুশি। তবে মাছের পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া, রায়মঙ্গল, কপোতাক্ষ ও কালিন্দি নদীর উপকূলবর্তী এলাকায় চিংড়ির চাষ বেশি হয়

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৪ হাজার ৯৩৫টি ঘেরে ৬৬ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে বাগদার উৎপাদন হয়েছে ৫৬ হাজার ৮১৬.১৬ মেট্রিক টন। ১১ হাজার ৬৬২টি ঘেরে নয় হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে গলদার উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৩৪৯.৮৪ মেট্রিক টন। অন্যান্য প্রজাতির দেশি চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৫৩৮৩ মেট্রিক টন। এসব চিংড়ি খামারের সঙ্গে জড়িত ৮৬ হাজার ৯৪৪ জন পুরুষ ও ৩৮ হাজার ৭৩৫ জন নারী। করোনায় চাষিদের ক্ষতি হয়েছে ৩৩৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আম্পানে ক্ষতি হয়েছে ১৭৭.১৭ কোটি টাকা। সবমিলে এক বছরে চিংড়ি চাষিদের ক্ষতি হয়েছে ৫১২ কোটি টাকা।

২৪ বছর ধরে চিংড়ি ব্যবসায় জড়িত রুহুল কুদ্দুস। শহরের করিম সুপার মার্কেটের একে ফিসের মালিক তিনি। বর্তমানে চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি।

রুহুল কুদ্দুস বলেন, করোনার মধ্যেই আম্পানে ঘেরের বাঁধ ভেঙে সব মাছ ভেসে গেল। ঘের মালিকরা এবার শেষ। এমন বিপর্যয় গত ১০ বছরেও দেখিনি। ঘের মালিকরা কোটি কোটি টাকা দেনা হয়ে আছেন। কেউ টাকা দিতে পারছেন না। চিংড়ি মৌসুমে বাকিতে চিংড়ি পোনা দিতে হয়েছে ঘের মালিকদের। নতুন করে আবারও তারা স্বপ্ন দেখছেন। তারা দাঁড়াতে না পারলে আমরাও শেষ।

জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় চিংড়ির পোনা ছাড়ার মৌসুম

শ্যামনগর উপজেলার চিংড়ি চাষি আব্দুল হামিদ বলেন, শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া, রায়মঙ্গল, কপোতাক্ষ ও কালিন্দি নদীর উপকূলবর্তী এলাকায় চিংড়ির চাষ বেশি হয়। এসব এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য এক বিঘা জমি লিজ নিতে হয়। প্রতি বছরের জন্য জমির মালিককে দিতে হয় ১০-১৪ হাজার টাকা। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় পোনা ছাড়ার মৌসুম। সুন্দরবনের উৎপাদিত রেণু ও চট্টগ্রাম, কলাতলী ও কক্সবাজারের বিভিন্ন হ্যাচারির সরবরাহকৃত রেণু ঘেরে ছাড়া হয়।

রেণু ছাড়ার পর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় বাগদা চিংড়ি আহরণ। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাপদাহ শুরু হলে ঘেরের পানি কমে যায়। এতে বেড়ে যায় পানির লবণাক্ততা। ফলে অনেক সময় মাছ মরে যায়। এজন্য ছোট মাছ ধরতে বাধ্য হন ঘের মালিকরা। এসব মাছ রফতানি না হওয়ায় দেশের বাজারে ৫০০-৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হয়।

সাতক্ষীরা চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বাবলা বলেন, বাংলাদেশ থেকে যত চিংড়ি রফতানি হয় তার অধিকাংশ সাতক্ষীরায় উৎপাদন হয়। করোনা ও আম্পানে এবার ক্ষতিগ্রস্ত ঘেরের মালিকরা। রফতানি না হওয়ায় কম দামে দেশের বাজারে বিক্রি করতে হয় চিংড়ি। তবে যে ক্ষতি হয়েছে ঘের মালিকদের, তা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, চিংড়ির জন্য নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। নতুন বাজার সৃষ্টি করতে না পারলে চাষিরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতে হলে এটি করতে হবে। করোনায় সরকার ৪ শতাংশ সুদে যে প্রণোদনা দিয়েছে, সেটিও অনেক ব্যবসায়ী পাননি। এখন চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ঘেরে মাছ ছেড়েছেন। এখন চাষিরা যেন নায্যমূল্য পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে চাষিরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

বাংলাদেশ থেকে যত চিংড়ি রফতানি হয় তার অধিকাংশ সাতক্ষীরায় উৎপাদন হয়

মৎস্য অধিদফতর খুলনার কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ তৌফিক আহম্মেদ বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মৎস্য খাতে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও কাকড়া রফতানি হয়েছে ২৯ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন। আয় হয়েছে দুই হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ২১ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন। আয় হয়েছে এক হাজার ৫৭১ কোটি টাকা।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, বর্তমানে চিংড়ির দাম একেবারেই কম। আগে যে চিংড়ির দাম ছিল ১২০০-১৫০০ টাকা সেই চিংড়ি এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকা। চিংড়ির চাহিদা বিদেশেও কমেছে। মূলত করোনার কারণে চিংড়িতে এই প্রভাব পড়েছে। ফলে চাষিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। যদি চিংড়ির দাম না বাড়ে তবে ঘের ব্যবসায়ীরা সাদা মাছের দিকে ঝুঁকবেন। চাহিদা না থাকা ও রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক না হওয়ায় চিংড়ির ভবিষ্যত নিয়ে হতাশায় আছেন চাষিরা।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা সাতক্ষীরা। একটি দুর্যোগের ক্ষত কাটিয়ে না উঠতেই আরেকটি দুর্যোগ আঘাত হানে। মূলত এই কারণেই চাষিরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না।

এএম