নানা ভাষার বইয়ে সমৃদ্ধ মা-ছেলের গ্রন্থাগার
মাহমুদা খাতুন
ভ্রমণপিপাসু দুই ভাই তানভির অপু ও তারেক অণু। ঘুরে বেড়ান দেশ-মহাদেশ। শখ বলতে ভ্রমণ বাদেও বই কেনা, বই পড়া এমনকি বই উপহার দেওয়া। যেখানেই যান, ছেলেরা মা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার জন্য কিনে আনেন দুষ্প্রাপ্য বই। দুর্মূল্য এসব বই নিজ হাতে গড়া গ্রন্থাগারে পরম মমতায় সাজিয়ে রাখেন মা।
নগরীর শিরোইল এলাকার দেওয়ান মঞ্জিল। বাড়ির চতুর্থ তলার চিলেকোঠায় দুই ছেলের সহায়তায় মাহমুদা খাতুন গড়ে তুলেছেন প্রায় দেড় হাজার বর্গফুটের গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে প্রাণ ও প্রকৃতি, ভ্রমণ, সাহিত্য, চিত্রকলা, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয়ক প্রায় পাঁচ হাজার বই। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও নানা ভাষার লেখা বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থাগার। এককথায় এটি এখন জ্ঞানের স্বর্গ।
বিজ্ঞাপন
২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল কর্মস্থলেই মারা যান স্বামী ইব্রাহিম আলী দেওয়ান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপপরিচালক হিসেবে ওই সময় পাবনায় কর্মরত ছিলেন তিনি। স্বামীকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যান মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। নিস্বর্গপ্রেমী দুই ছেলেকে ঘরে আটকে রাখার সাধ্যি তার নেই। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সংসারে। দিনের বেভির ভাগ সময় তিনি একা থাকেন বাসায়। কিন্তু কখনো একাকিত্ব অনুভব করেন না। সব সময় বই তাকে বন্ধুর মতো সঙ্গ দেয়।
বাসার ছাদের একটি অংশে শখের বাগান গড়ে তুলেছেন মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা। এই বাগানে রয়েছে নানা জাতের ফুল-ফল। নকশা করা পেঁচানো সিঁড়ি চলে গ্রন্থাগারের ছাদে। গ্রন্থাগারের সাজসজ্জায় রয়েছে আভিজাত্য। বাসার বৈঠকখানার মতোই পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। সরেজমিনে স্বপ্নের গ্রন্থাগারেই পাওয়া গেল মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাকে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, শৈশব থেকেই বই পড়ার প্রতি ভীষণ রকম ঝোঁক ছিল তার। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজশাহী কলেজে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। পাঠ্যসূচিতে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’থেকে ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধ পড়েন ওই সময়। সেই থেকে বই পড়া গেঁথে যায় মনে। স্নাতক শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের চালু করা বৈকালিক ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্স করেন। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যায় বহুগুণে।
বইয়ের টানে অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেননি। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গন্থাগারে যোগ দেন। সেখানেই কেটে যায় ৪১ বছর। ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে ২০১৭ সালের ৩০ জুন অবসরে যান তিনি। অবসরে গিয়েও বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে এতটুকু ভাটা পড়েনি তার। অবসর ভেঙে গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে নগরীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
তিনি বলেন, জ্ঞানের ভান্ডারেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। শুরু থেকেই তার ভাবনায় ছিল সাধারণ মানুষের জন্য গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা। অবসরে যাওয়ার পর প্রাপ্ত পেনশনের টাকা দিয়ে চারতলা ভবনের চিলেকোঠায় গড়ে তুলেন এই গ্রন্থাগার।
কীভাবে পুরো পরিবার বইয়ের প্রেমে পড়ল, জানতে চাইলে মাহমুদা জানান, দুই ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছুটির পর বাসের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হতো। এই সময়টুকু বই নিয়ে রাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারেই কাটত। সেই থেকে মায়ের মতোই বইয়ের পোকা হয়ে যান তারাও।
তিনি যোগ করেন, ছেলে-মেয়েদের সব সময় বই পড়ায় উৎসাহ দিতেন তিনি। তাদের জন্মদিনে বই উপহার দিতেন। যেখানেই যেতেন, বাড়ি ফিরতেন বই হাতে। ভ্রমণ, এমনকি চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েও সঙ্গে বই কিনে আনতেন। ছেলেরাও প্রচুর বই কেনেন। বিদেশ ভ্রমণে গিয়েও বই কেনেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তাদের বন্ধুরাও বই পাঠান। বই কিনতে কিনতে ঘরে প্রচুর বই জমে যায়। গ্রন্থাগারে এসব বই স্থান পেয়েছে।
এখনো কিছু বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলোর শ্রেণিবিন্যাস ও ক্যাটালগ হয়নি। তা ছাড়া কিছু আসবাব লাগবে জানিয়ে মাহমুদা বলেন, দেখানোর জন্য জনবল নেই। করোনার জন্য এসব কাজ থমকে আছে। গুছিয়ে নিতে আরও একটু সময় লাগবে। সব কাজ শেষ হলেই তিনি সাধারণের জন্য তার এই গ্রন্থাগারের দরজা খুলে দিতে চান।
৪১ বছরে কর্মজীবনে গ্রন্থাগারের অনেক পরিবর্তন দেখেছেন তিনি। তার ভাষ্য, ২০১৭ সালের আগেও রাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে অনেক শিক্ষক বইপাঠে নিমগ্ন থাকতেন। ঘড়ির কাঁটা তাদের জন্য থেমে যেত। শিক্ষার্থীদেরও জায়গা দেওয়া যেত না। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। প্রায় সব গ্রন্থাগারেই ‘ই-বুক’। ঘরে বসেই কম্পিউটার-মোবাইলে বই পড়ছে মানুষ। গ্রন্থাগারের তাক থেকে পছন্দের বই নামিয়ে, হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ আলাদা। সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখনকার প্রজন্ম।
একটা সময় ছিল, পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার থাকত। লোকজন আনন্দের সঙ্গে বই পড়তেন। এখন আর সেটা নেই। হয়তো সময় সল্পতায় বই পড়তে পারেন না মানুষজন। এখনকার লেখকরাও বাণিজ্যিক। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখেন। তাদের খেলায় সামাজিক বাস্তবতা ফুটে ওঠে না।
মায়ের গ্রন্থাগার ঘুরিয়ে দেখালেন শতাধিক দেশ ঘুরে আসা ছোট ছেলে তারেক অণু। পরিচয় করিয়ে দিলেন দুষ্প্রাপ্য সব বইয়ের সঙ্গে। জানালেন সংগ্রহের আদ্যোপান্ত। জগদ্বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ অন্যতম সংগ্রহ এই গ্রন্থাগারে। নিস্বর্গপ্রিয় ও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে এটি পবিত্র গ্রন্থের মতোই সমাদৃত। গত ১২২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’যতগুলো সংখ্যা ছেপেছে, তার প্রায় সবই সংগ্রহ করেছেন তারা।
প্রকৃতি, জীবজগৎ, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও বিজ্ঞানের নানা বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য বিখ্যাত ডেভিড অ্যাটেনবোরো। তার লেখা সব বই রয়েছে এখানে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের পথিকৃৎ জেরাল্ড ডারেলের খেলা প্রায় সব বইয়ের ইংরেজি ও বাংলা সংস্করণও রয়েছে। পিঁপড়া থেকে শুরু করে নীল তিমি পর্যন্ত বিশ্ববিস্তৃত সব প্রাণী নিয়ে সমৃদ্ধ বই প্রকাশ করে খ্যাতি পেয়েছে রেক্টন কোম্পানি। তাদেরও প্রায় সব বই রয়েছে পারিবারিক এই গ্রন্থাগারে।
অণু আরও বলেন, চিত্রকলার ওপরে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত টাইমলাইফ সিরিজের প্রকাশিত ২৮টি বইয়ের ২৬টিই রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। পৃথিবীর মানবসভ্যতার বাঁক নিয়ে টাইমলাইফ সিরিজের আরও বেশ কিছু বই রয়েছে এখানে। এই বইগুলো দুষ্প্রাপ্য। এগুলো যারা পেতে চান, দেশের যে কোনো প্রান্তে বসে কীভাবে পেতে পারেন, সেই চেষ্টাও আমরা করব।
ভ্রমণবিষয়ক বাংলায় যতগুলো বই প্রকাশ হয়েছে, এর অধিকাংশই রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। বাদ পড়েনি ইংরেজি ভ্রমণবিষয়ক বই। বাংলাগুলো কলকাতা থেকে সংগ্রহ করা। ইংরেজিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত ভ্রমণে গিয়ে তারা সংগ্রহ করেছেন। এরই মধ্যে হাজারখানেক ভ্রমণবিষয়ক বই চলে এসছে তাদের সংগ্রহে। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ভ্রমণবিষক বইগুলো তারা সংগ্রহে রাখতে চান। যাতে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা উপকৃত হন।
জানতে চাইলে এই বইপ্রেমী বলেন, নিস্বর্গ ও ভ্রমণবিষয়ক বইয়ে পারিবারিক এই গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ করতে চান তারা। যাতে রাজশাহীর মতো নিরিবিলি শহরে, যেখানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার কিংবা বইয়ের দোকান নেই, সেখানে বসে নিঃস্বর্গ সম্পর্কে তরুণরা জানতে পারেন।
ছোট ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন বড় ভাই তানভীর অপু। নাগরিকত্ব নিয়ে ১৫ বছর ধরে তিনি বাস করছেন ফিনল্যান্ডে। এই ১৫ বছরে তিনি ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর ১৭৭টি দেশের ৮১৫টি শহর। নিজেদের গ্রন্থাগারে পাওয়া গেল তাকেও। এমন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য তিনি জানান।
অপু বলেন, বিভিন্ন শহর ও দেশ ঘুরে আমি যা দেখেছি, মানুষের উন্নতি এবং আবিষ্কারের পেছনে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ইউরোপের প্রতিটি বাসায়, যে গৃহকর্তা একেবারেই গরিব, কৃষক এমনকি কম বেতনে চাকরি করেন, তিনিও নিজের বাসায় ছোট্ট একটা বইয়ের সেলফ রেখেছেন।
বাসে-ট্রামে ভ্রমণ ও পার্কে সময় কাটানোর সময়টুকুনও বই সঙ্গী করছেন তারা। আর এ কারণেই সেখানে জ্ঞানী-বিজ্ঞানী জন্ম নিচ্ছেন। সভ্যতার ভেতর দিয়ে উন্নতির চরম শেখরে যাচ্ছেন তারা। আমাদের দেশে অনেকের বিশাল বিত্তবৈভব। কিন্তু কেউ কখনো বলেন না, তার বাড়িতে এক আলমারি বই আছে। এই কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে।
তিনি যোগ করেন, অন্যদের চেয়ে তাদের চিন্তাভাবনা একটু আলাদা। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এমন সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে পেরেছেন। তারা প্রথিবীর যে দেশে ভ্রমণ করেছেন, সেখান থেকেই সঙ্গে করে বই এনেছি। এই গ্রন্থাগারের ৮০ শতাংশ বই দেশের বাইরের। ভ্রমণে গিয়ে বাঁচানো অর্থে গিফ্ট না কিনে তারা বই কিনেছেন। মূলত পুরাতন বইয়ের বাজার ঘুরে এসব বই সংগ্রহ করেছেন।
তাদের এই উদ্যোগ ব্যয়বহুল জানিয়ে অপু জানান, এত বড় পরিসরে পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার সামর্থ্য হয়তো অনেকের না-ও থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি গ্রন্থাগার থাকুক। তারা এই স্বপ্ন দেখেন। তারা চান, শিশুরা ঘর থেকেই জ্ঞান নিয়ে বড় হোক। সামাজিক এই আন্দোলন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেও চান তারা।
বন্ধু স্বজনদের বেশি বেশি বই উপহারের তাগিদ দেন এই বইপ্রেমী। বলেন, বই উপহার দিলে সেটি স্মৃতি হয়ে সারাজীবন রয়ে যায়। বইটি পরিবারের সদস্য হয়ে জীবনভর থেকেই যাবে। একসময় মনে করিয়ে দেবে ফেলে আসা অতীত। ইউরোপ-আমেরিকায় এমন রীতি চালু আছে, যা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। তারা চান দেশেও এই ধারা চালু হোক।
এনএ