প্রতিদিন কলেজে যেতে স্কুটি চান সোহান
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান (১৭)। জন্মগতভাবে শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী সোহান ঠিকমতো কথা বলতে ও হাঁটতে পারেন না। একটি হাতও নেই তার।
অল্প সময়ের পথ অনেক সময় নিয়ে হাঁটতে হয়। নিজস্ব কোনও যানবাহন নেই তার। তবে সহজে স্বাচ্ছন্দ্যে কলেজে যেতে একটি স্কুটি হতে পারে তার কষ্ট লাঘবের সঙ্গী। কিন্তু দরিদ্র কৃষক বাবার সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। তাই দরিদ্র পরিবারের ছেলে সোহানের কাছে স্কুটি কেনার স্বপ্ন যেন বিলাসিতা।
বিজ্ঞাপন
তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্রতা- জীবনের এই বাঁধা ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান সোহান। বোঝা নয় সমাজ, দেশের জন্য কিছু করতে চান তিনি। তাই পড়াশোনা এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্কুটি উপহার পেতে চান সোহান। স্কুটি পেলে সময়মতো কলেজে পৌঁছাতে পারবেন বলে জানান তিনি।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক শফিক মন্ডল ও শাহানা বেগম দম্পত্তির ছেলে সোহান।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, আর্থিক সমস্যার কারণে সোহান এসএসসি পর্যন্ত নানা বাড়ি ফরিপুরের মধুখালী থেকে লেখাপড়া করেন। কালপোহা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে ৩.৪৫ জিপিএ পেয়ে জেএসসি পাশ করেন। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০২১ সালে ২.৪৪ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করে।
ডান হাতে শক্তি না থাকার কারণে বাম হাত দিয়ে লিখতে হয় সোহানকে। হাতে ধীরগতির কারণে পরীক্ষার সময় অনেক বেগ পেতে হয়।
লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন সোহান। ২০২২ ও ২০২৩ সালে টানা দুইবার বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ স্টাডিজ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে “গ” গ্রুপে অংশগ্রহণ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তিনি।
অস্পষ্ট ভাষায় সোহান জানান, প্রতিবন্ধী ভাতা পান তিনি। সেই টাকায় লেখাপড়ার খরচ চলে। এখন তার একটি স্কুটি প্রয়োজন। স্কুটি পেলে সে সময় মতো কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক কিছু করেছেন জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সোহানের বাবা শফিক মন্ডল বলেন, ছোটবেলা থেকেই সোহান শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। ঠিক মত হাঁটাচলা ও কথা বলতে পারে না। অর্থের অভাবে আমরা সোহানকে চিকিৎসা করাতে পারিনি। তবে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে আমরা কষ্ট করেও ওর পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। কলেজে যাওয়ার জন্য ওর একটা স্কুটি প্রয়োজন, যেটা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমার প্রতিবন্ধী ছেলেকে কলেজে যাওয়া-আসার জন্য একটি স্কুটির ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে আমরা তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থকতাম।
সোহানের মা শাহানা বেগম বলেন, ‘প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম নেওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে ওর শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। সে হাঁটা শেখে ৭ বছর বয়সের পর। এখনও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। কথাও বলতে পারে না। মুখটা বাঁকা। এতোসব প্রতিবন্ধকতা নিয়েও সে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে আমি আবেদন করি ওরে যেনো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। যাতে আমার ছেলেটা কর্ম করে খেতে পারে’।
প্রতিবেশী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সোহান ছোটবেলা থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। সব প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে সে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার সে তার বাবার কৃষিকাজেও সহযোগিতা করছে। সে সমাজের সবার জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে’।
সোহানের সহপাঠী সাদ্দাম হোসেন বলেন, সোহান প্রতিদিন কলেজে আসে। কিন্তু সে শারিরীক প্রতিবন্ধী। ঠিক মত হাঁটাচলা করতে পারে না। অনেক কষ্ট করে সে কলেজ আসে।
সোহানের কলেজের শিক্ষক প্রভাষক মো. রকিবুল ইসলাম রকিব জানান, সোহান শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। তবে সে মেধাবী ছাত্র। সে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। প্রতিবন্ধী হলেও সে নিয়মিত কলেজে আসে, ক্লাস করে। ঠিক মত হাঁটতে না পারায় কলেজে সময়মতো আসতে পারে না। প্রায়ই দেরি করে আসে। একটি স্কুটি হলে ওর অনেক উপকার হতো।
বহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানান, সোহান শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। সে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। সে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্কুটি উপহার পেতে চায়। যেটা দিয়ে সে কলেজে যাতায়াত করতে পারবে।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধী সোহান সমাজের অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে একটি ছেলে সংগ্রাম করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে এটা সবার জন্য একটি অনুপ্রেরণা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে সোহানের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। সে নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে। সমাজের বিত্তশালীদের সোহানের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।
মীর সামসুজ্জামান/এনটি