নীলফামারীতে উপহারের ১০ ঘর বিক্রি করে দিলেন সুবিধাভোগীরা
৫৭ হাজার টাকায় কেনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে চুক্তিপত্র হাতে মমিনুর-মহছেনা দম্পতি। ছবি : ঢাকা পোস্ট
নীলফামারীর ডিমলায় মুজিববর্ষ উপলেক্ষ্য ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ১০টি ঘর বিক্রির অভিযোগ উঠেছে সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি ঘর বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। বরাদ্দপ্রাপ্তরা ঘর বিক্রি করে চলে যাওয়ায় বর্তমানে ঘরগুলোতে বসবাস করছেন ক্রয় করা ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের কেল্লাপাড়া গ্রামে মুজিববর্ষ উপলেক্ষ্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৫০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ঘরগুলো সুবিধাভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জনপ্রতি দুই শতক জমিসহ একটি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এই ৫০টি ঘর থেকে ১০টি ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়রা বলছেন, ঘর বরাদ্দের তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনিয়ম করেছেন। ফলে প্রকৃত ভূমিহীনরা সরকারের এসব ঘর বরাদ্দ পাননি। জমি আছে, পাকা ঘরও আছে এমন ব্যক্তিরাও ঘর পেয়েছেন। এখন তারাই লাভের আশায় সরকারের দেওয়া ঘর বিক্রি করছেন।
>>> ‘তোমরা হামাক ফাঁসি দিলে দেন, তাহো মুই নৌকাত ভোট দিম’
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, কেল্লাপাড়া গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩২ নম্বর ঘর বরাদ্দ রয়েছে রমিছা বেগমের নামে। সরকারি বিভিন্ন নথিতে তার নাম রয়েছে। অথচ ঘরটিতে এখন বসবাস করছেন আফাজ উদ্দিন ও আকতারা দম্পতি।
বর্তমানে ঘরে বসবাস করা আকতারা বেগম জানান, চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ৯৫ হাজার টাকায় তিনি রমিছা বেগমের কাছ থেকে ঘর কিনেছেন।
২৬ নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান ও মমেনা খাতুন দম্পতি। চুক্তিপত্রের মাধ্যমে এই ঘর ৫০ হাজার টাকায় কিনে সেখানে বসবাস করছেন সোকজান বেগম।
২৫ নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন সুফিয়া খাতুন ও নুর ইসলাম দম্পতি। তাদের কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকায় ঘরটি কিনে বসবাস করছেন শাহ আলম ও তার পরিবার। ৫০ নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন সুরুজ্জামান আলী ও তার স্ত্রী হালিমা খাতুন। তাদের কাছে থেকে এই ঘর ৫৭ হাজার টাকায় কিনে বসবাস করছেন মহছেনা বেগম ও মমিনুর রহমান দম্পতি। ৪৪ নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন লিটন ইসলাম। তার কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকায় ঘরটি কিনে সেখানে বসবাস করছেন জাবিতন বেগম ও তার পরিবার।
একইভাবে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২, ৩০, ৩৩, ৩৭ ও ৩৯ নম্বর ঘর টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন উপকারভোগীরা।
আশ্রয়ণের অন্য বাসিন্দারা জানান, এসব ঘর যাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তারা এখন কেউ এখানে নেই। যারা টাকা দিয়ে কিনেছেন, তারাই এখন বসবাস করছেন।
এসব ঘরে বসবাসকারী ব্যক্তিরা টাকা দিয়ে ঘর কিনে নেওয়ার কথা স্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে জানান, তাদের কোনো বাড়িঘর ও জমিজমা নেই। আবেদন করেও তারা সরকারের ঘর বরাদ্দ পাননি। তাই নিরুপায় হয়ে বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে ঘর কিনে বসবাস করছেন।
>>> ‘ঘরটা পেয়ে ধন্য হয়েছি, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’
২৬ নম্বর ঘর কিনে বসবাস করা বিধবা সোকজান বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ঘরবাড়ি নেই, জমিও নেই। ভিক্ষাবৃত্তি করে খেয়ে না খেয়ে ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করে সিদ্দিকুরের কাছ থেকে এই ঘর কিনেছি। সিদ্দিক আমার নামে চুক্তিপত্র করে দিয়েছেন।
এ ছাড়া টাকা দিয়ে ঘর কেনার কথা স্বীকার করেছেন শাহ আলম, আকতারা বেগম, জাবিতন ও ইয়াসমিন। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকা দিয়ে ঘর কিনে এখানে বসবাস করছি। কিন্তু বরাদ্দপ্রাপ্তরা ঘর বিক্রি করে চলে গেলেও সরকারি সব সুবিধা ও প্রশিক্ষণ এখনো তারাই পাচ্ছেন। অথচ প্রকৃত ভূমিহীনেরা সরকারের এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
২৫ নম্বর ঘরের বরাদ্দ পাওয়া নুর ইসলাম ঘর বিক্রির কথা স্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শাহ আলম ভূমিহীন। আমার যেহেতু বাড়িঘর আছে, তাই ৪০ হাজার টাকায় তার কাছে ঘরটি বিক্রি করেছি।
আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি করা আরেক উপকারভোগী সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিক্রি করিনি, তবে আমি যেহেতু ওই বাড়িতে থাকি না, তাই বাড়িটিতে থাকতে দিয়েছি। লিখিত চুক্তিপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
ঘর বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সে সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি সদস্যরা তালিকা করেছিলেন। এখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বেলায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বিক্রি বা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। ঘর বিক্রির বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শরিফুল ইসলাম/আরএআর