বাধ্য হয়েই সন্তানের হাতে মোবাইল দেন বাবা-মা
মোবাইল ফোনে শিশুদের আসক্তি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। খেলাধুলা, বিনোদন, পড়াশোনা কিংবা পারিবারিক আড্ডা সবকিছুকে পেছনে ফেলে মোবাইলে বেশি সময় ব্যয় করছে শিশুরা। এই আসক্তি এখনই না থামাতে পারলে শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে- এমনই উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় রয়েছেন অভিভাবক, শিক্ষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক এবং শিক্ষক।
বিজ্ঞাপন
কুমিল্লা ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকদের অপেক্ষাগারে কথা হয় সিমা আক্তার নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার দুইটা বাচ্চা। একজন ক্লাস সেভেনে পড়ে আরেকজন ক্লাস ওয়ানে। স্কুল থেকে টিচাররা হোয়াটসঅ্যাপে পড়া দিচ্ছে- এই কারণ দেখিয়ে ওরা মোবাইলটা হাতে নেয়। টিচারের দেওয়া পড়াটা দেখেই বসে যায় গেমস নিয়ে। পড়ার থেকে তাদের গেমসের প্রতি আসক্তি অনেক বেশি। আবার তাদের কিছু বলা যায় না, কিংবা মোবাইলটাও ছিনিয়ে আনা যায় না। প্রচুর জেদ ধরে। মোবাইল না দিলে খাবার খেতে চায় না, জেদ ধরে কথা বলতে চায় না। তখন বাধ্য হয়েই মোবাইল দিতে হয়।
আফরোজা জাহান নামে একই স্কুলের আরও এক অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মেয়ে মোবাইলে তেমন আসক্ত নয়, কিন্তু ছেলেটা প্রচুর আসক্ত। ছেলেটা সারাক্ষণ যতক্ষণ বাসায় থাকে বিভিন্ন অজুহাতে মোবাইল নিয়ে গেমস খেলে। ছেলেটার দেখাদেখি মেয়েটাও মাঝে মাঝে জেদ ধরছে। যে সময়টাতে একটু খেলাধুলা করে শরীরচর্চা করবে সেসময়টাতে মোবাইল নিয়ে মগ্ন থাকে। যতটুকু পারি বুঝিয়ে সুজিয়ে মোবাইল থেকে দূরে রাখি।
বিজ্ঞাপন
শহীদুল ইসলাম নামে একজন কলেজশিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাচ্চাটা ক্লাস থ্রিতে পড়ছে। গতকাল আমি যখন বাসায় গেলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম আম্মু তোমার তো কাল পরীক্ষা, পড়াগুলো কি শেষ হয়েছে? মেয়েটা বললো শেষ হয়েছে। আমি তখন পড়াগুলো নিতে গিয়ে দেখলাম সে মোটেই কিছু পড়েনি। আমি যখন নামাজ পড়তে দাঁড়াই, ওর আম্মু যখন বাড়ির কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন সে মোবাইল নিয়ে বসে যায়। এতটুকু একটা বাচ্চা শুধুমাত্র মোবাইলের জন্য চাতুরতা দেখাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই উৎকণ্ঠার বিষয়। তবুও যতটুকু আয়ত্তে রাখা যায়, আমি আর তার মা সেই চেষ্টা করি।
রাহেনূর আক্তার রূপা নামে একজন অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালে স্কুল বন্ধের সময় মোবাইলের মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া শুরু হয়। তখন থেকে বাচ্চাদের মোবাইলের সঙ্গে সখ্যতা হয়। পরবর্তীতে করোনা শেষ হওয়ার পরও তারা মোবাইল ছাড়ছে না। তবে আমি আমার মেয়েদের সঙ্গে খুব বন্ধুসুলভ। তারা যেকোনো কিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করে। ইন্টারনেটে একটা জিনিস দেখে শিখছে, সেটা আবার আমাকে বলছে। আমি তাদের উৎসাহিত করি। ঠিক যতটুকু সময় মনে হয় তাদের একটু মোবাইল দেখা দরকার, ততটুকু সময়ই মোবাইল হাতে রাখে। আমি নিষেধ করলে আর মোবাইল ধরে না। আমার বাচ্চাদের মোবাইলে আসক্তি কম তবে তাদের মুখে তাদের বন্ধুদের গল্প শুনি। অমুকে এই দামের ফোন ব্যবহার করছে, তমুকে এই দামের ফোন ব্যবহার করছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করে তাদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা।
বরুড়া শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তির বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। ইতোমধ্যেই আমরা বেশ কয়েকটি ঘটনা জেনেছি। মৌলভীবাজারে এক মা তার ছেলেকে মেরে ফেললেন। বেশ কিছু অঞ্চলে মোবাইল না দেওয়ায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে মূলত নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আসক্তি বেশি থাকে মানুষের। মোবাইল ফোন শিশুদের শিক্ষা সহায়ক হিসেবে কাজ করছে এটা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি, শিশুরা মোবাইলের অপব্যবহারও করে এটাও সত্য। এই অপব্যবহারের ফলেই মূলত অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইল ফোন অপব্যবহারের ফলে তার যেমন শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মানসিক ক্ষতিও কিন্তু হচ্ছে। তাই আমাদের অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে, এর বিকল্প কিছু হতে পারে না।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবির মাসউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন আচরণ করে, মোবাইল না পেলে একটা শিশু সেইম আচরণটাই করবে। হরমোন ক্ষরণের কারণে একটি ছেলে রাস্তাঘাটে বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, মোবাইল না পেলে সে একই আচরণ করবে। মাদকাসক্তের জন্য কিন্তু নিরাময় কেন্দ্র আছে, চিকিৎসা কেন্দ্র আছে, কিন্তু ভার্চুয়াল এডিকশানের কোনো নিরাময় কেন্দ্র নেই। যার কারণে এখন সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করবে, বাবা-মা সন্তানকে হত্যা করবে, একটা অস্থির অবস্থা। মোবাইলের ইতিবাচক দিক আছে, ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার অনেক সহযোগী উপক্রম পাচ্ছে। কিন্তু নিষিদ্ধ যেসব বিষয় রয়েছে তারা সেটাকেই গ্রহণ করছে বেশি বেশি। তাই অভিভাবকদেরই এগিয়ে আসতে হবে এটিকে রোধ করতে হলে।
তবে ডিজিটাল যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের জীবনমান উন্নত করতে মোবাইল ফোন অবশ্যই ব্যবহার করতে দিতে হবে বলে মত দিয়েছেন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামাল নাসের। আবার সেটার যেন অপব্যবহার না করতে পারে সেজন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল আমাদের জীবনে প্রচণ্ড গতি এনেছে এটি অস্বীকার করা যাবে না। মোবাইলের কারণেই অতিমারি করোনার সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েনি। কিন্তু একইভাবে শিক্ষার্থীরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে বহুগুণ। এর কারণ হচ্ছে মোবাইলে কিছু গেমস আছে যেগুলো শিশুদের মনকে প্রলুব্ধ করে। এর ফলে মোবাইলের প্রতি আসক্তি মহামারি আকার ধারণ করেছে। যে কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। প্রথমতো তারা মাঠে গিয়ে খেলা থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে, সমাজ বিমুখ হয়ে যাচ্ছে, পরিবার বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। আড্ডা দিতে পছন্দ করে না, গল্প করতে পছন্দ করে না, বই, সাহিত্য, উপন্যাস পড়তে পছন্দ করে না। এই মোবাইল নিয়েই ওরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকছে। এটিকে যদি রোধ না করা যায় তাহলে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় নামবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি অভিভাবক এবং পরিবারকে অবশ্যই সচেতনতার সঙ্গে শিশুদের এই মোবাইল আসক্তি রোধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
আরিফ আজগর/আরএআর