ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিরাপদে ভোট দিতে চান সারা দেশের ভোটাররা/ ফাইল ছবি

>>> ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা বড় চ্যালেঞ্জ
>>> বড় ভীতি রাজনৈতিক সহিংসতা 
>>> ভোট পড়ার হার উদ্বেগজনক

দেশের উত্তরাঞ্চলের শহর রংপুরের বাসিন্দা চল্লিশোর্ধ্ব মাহমুদা বেগম সর্বশেষ ভোট দিতে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সেদিন ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ভোট না দিয়েই ফিরে যান তিনি। এরপর থেকে ভোটদানে আগ্রহ হারিয়েছেন এই নারী।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহমুদা বেগমের। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাইনি। ভোটের সময় অনেক জায়গায় মারামারি, হামলা-ভাঙচুর হয়। নির্বাচন এলেই টিভি চ্যানেল আর পেপার-পত্রিকায় শুধু সহিংসতার খবর। এসব জানার পর কি ভোটকেন্দ্রে যেতে মন চায়?

তিনি আরও বলেন, ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয় লাগে, কখন কী হয়। ২০১৪ সালে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, ভোট দেবো। হঠাৎ শুনি ককটেল পাওয়া গেছে। সেদিন ভোট না দিয়েই ফিরে এসেছিলাম।

একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা নতুন ভোটার নাছরিন আক্তার। ২০১৪ সালে প্রথম ভোট দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন ভোটার হয়েও ভোটকেন্দ্রে যাওয়া হয়নি তার।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে নাছরিন আক্তার বলেন, সাধারণ ভোটারদের ওপর প্রার্থীদের আস্থা নেই। তারা রাজনৈতিক সহিংসতা, কোন্দল আর কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। ভোটারদের কাছে নির্বাচন উৎসবের, আনন্দের। অথচ এখন কোনো নির্বাচনই স্বস্তির নয়। সবসময় একটা অজানা আতঙ্ক ও ভীতি কাজ করে। এ কারণে আমার মতো অনেকে ভোট দিতে চান না।

মাহমুদা ও নাছরিনের মতো হাজার হাজার ভোটার এখন ভোটবিমুখ। যার প্রমাণ মিলেছে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। ওই সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। 

এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালে এই সিটির নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এবার নতুন ভোটার বাড়লেও কমেছে ভোটার উপস্থিতির হার।

এ চিত্র শুধু রংপুর সিটিতে নয়, বিগত কয়েকটি উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু নির্বাচনে ভোটের হার কমতে দেখা গেছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট পড়ার হার উদ্বেগজনক

রংপুর সিটির চেয়েও কম ভোট পড়েছে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে। সেখানে ভোট পড়েছে ৪৮.৭৫ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালে এই সিটিতে ভোট পড়েছিল ৫৭.০২ শতাংশ। খুলনা সিটি নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৭.৮৫ শতাংশ, আগেরবার ভোট পড়েছিল ৬২.১৯ শতাংশ। বরিশাল সিটি করপোরেশনে এবার ভোট পড়েছে ৫১.৪৬ শতাংশ, ২০১৮ সালে পড়েছিল ৬৪ শতাংশ। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৫ শতাংশ। রাজশাহী সিটি নির্বাচনে এবার ভোট পড়েছে ৫৬.২ শতাংশ। ২০১৮ সালে পড়ে ৭৮.৮৬ শতাংশ।

সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির দিকে তাকালে উদ্বেগের বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হবে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটের হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১১.৫১ শতাংশে। আর চট্টগ্রাম-৮ আসনে ভোটের হার ছিল ১৪.৫৫ শতাংশ। তারও আগে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৪ ও ৬ আসনের উপনির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। ওই ছয়টির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে। সেখানে ভোটের হার ছিল ১৬.১ শতাংশ।

গত ৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮.২৩ শতাংশ। ফরিদপুর-২ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম, ভোট পড়ে মাত্র ২৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে মাঝেমধ্যে কিছু পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ভালো ছিল।

সংসদ নির্বাচনেও কমছে ভোটার উপস্থিতি

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য মতে, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভোট বর্জনের নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম সংসদ নির্বাচন। চোখে পড়ার মতো ভোটার উপস্থিতি না থাকায় সেই নির্বাচন নিয়ে সর্বত্র প্রশ্ন ওঠে। ভোটার উপস্থিতি নেমে দাঁড়ায় ৪০.০৪ শতাংশে।

ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে। বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করায় ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে শুধু তিনটি আসনে ভোট দিতে পেরেছেন ভোটাররা। বাকিগুলোতে নির্বাচন হয়নি।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ওই নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে দাবি করে নির্বাচন কমিশন। যদিও তাদের দাবি নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা চান সাধারণ ভোটাররা

এখন চলছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। সাধারণ ভোটাররা বলছেন, যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতা, নির্বাচন বর্জনের প্রবণতা আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী জনপ্রতিনিধি দিয়ে দেশ চালানোর প্রক্রিয়ায় বেশির ভাগ ভোটার খুশি নন। 

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দেউতি হাউদারপার এলাকার ব্যবসায়ী সৈয়দ বোরহান কবির বলছিলেন এমনকিছুই। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সহিংস পরিস্থিতির কারণে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দেওয়া হয়নি তার।

বোরহান কবির ঢাকা পোস্টেকে বলেন, আমার এলাকায় ২০১৪ সালে ভোট হয়নি। ওই সময় প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং এজেন্টসহ কেউই ভয়ে কেন্দ্রে আসেননি। পুলিশ-বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মেকুড়ায় দুইজন মারা যান। পার্শ্ববর্তী জোড়ইন্দ্রা এলাকায় একটি কেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়।

তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি এলাকার এক নারী ভোটার বলেন, ২০১৪ সালে ভোট দিতে পারিনি। ভোট না দিয়েই এমপি পেয়েছি। সব নির্বাচনেই আমার নিজের ভোটটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দিতে চাই। কিন্তু এখন ভোট দেওয়ার পরিবেশ নেই, শক্ত কোনো প্রার্থীও থাকে না।

রংপুর-৪ আসনের (পীরগাছা ও কাউনিয়া) সংসদ সদস্য টিপু মুনশি। তিনি বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। তার নির্বাচনী এলাকার অন্তত ২০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে নির্বাচন ও ভোটদান প্রসঙ্গে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার দুই শিক্ষক অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থা কমে এসেছে। বিগত নির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে। ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি এলাকার এক নারী ভোটার বলেন, সব নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে চাই। কিন্তু এখন ভোট দেওয়ার পরিবেশ নেই, শক্ত কোনো প্রার্থীও থাকে না।

জেলার কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক বলছেন, গত এক দশক ধরে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মাঝে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোটাররা কেন্দ্রমুখী হচ্ছেন না।

রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

স্থানীয় সরকার ও সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার তলানিতে নামতে থাকা সুখকর নয় বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকসহ পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট পড়ার হার কমে এসেছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এর নেপথ্যে তৃণমূলে রাজনৈতিক নেতাদের অবমূল্যায়ন, ব্যবসায়ীদের প্রধান্য ও মনোনয়ন দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটের ফলাফল উল্টিয়ে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্টদের বের করে দেওয়া, সংঘর্ষের আশঙ্কা এবং একজনের ভোট অন্যজন দিয়ে দেওয়া অন্যতম কারণ।

রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, বর্তমান অবস্থার উন্নতি করা শুধু নির্বাচন কমিশনের একার দায়িত্ব নয়; এই দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার। 

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) রংপুর জেলা কমিটির সমন্বয়ক আব্দুল কুদ্দসু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও ভোট কারচুপির ব্যাপক ও দৃশ্যমান অভিযোগ এবং এসব অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা ভোটারদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা তৈরি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনের উপ-নির্বাচনে।

জানতে চাইলে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাশেম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করেছে। এ কারণে কোনো কোনো জায়গায় আশানুরূপ ভোট পড়েনি। সহিংস ঘটনাগুলোতে ভোটাররা ভয়ে কেন্দ্রে যাননি। 

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচনে ভোট কম পড়ার নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে। কোনো দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাদের কর্মী-সমর্থকরা ভোট দিতে যায় না। সেটাও ভোট কম পড়ার একটি কারণ হতে পারে। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখন মানুষ ভোটকেন্দ্রমুখী।

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা হলো নির্বাচন। কিন্তু সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দল জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে খেলছে। যদি জনগণের ভোটের অধিকার না থাকে, ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা না থাকে সেই নির্বাচনে বিএনপি কেন অংশ নেবে? ভোটবিহীন, ভোটারবিহীন গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। এজন্য তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় পায়। জনগণের দাবি মেনে নির্বাচন দিলেই দেশে ভোট উৎসব হবে।

তিনি আরও বলেন, ভোটাররা যদি তাদের পছন্দের প্রার্থী বা দলকে ভোটই দিতে না পারে, তাহলে কি একে নির্বাচন বলা যায়? যেখানে ভোটারের ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে বিএনপি থাকা না থাকা কোনো বিষয় নয়।

বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ) রংপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতন্ত্র এবং জবাবদিহিতামূলক সরকার ব্যবস্থা এখন জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা দেখতে চায়। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এর সংস্কারও দেখতে চায়। এটা না হলে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। 

ভোট পড়ার হার কমার নেপথ্যে 

নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব, পাল্টাপাল্টি দোষারোপের প্রবণতা, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ, সহিংসতা, ভোট বর্জনরীতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে ইসির দুর্বলতা এবং বড় দুই দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ভোটারদের আস্থায় চিড় ধরেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় কমছে ভোট পড়ার হার। সেই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বাড়ছে অনীহা। গত এক দশক ধরে বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট কম পড়ার নেপথ্যে এমন একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

সুজনের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু ঢাকা পোস্টেকে বলেন, ‘আগের মতো রাজনীতিবিদ নেই, নেতা নেই, তৃণমূলে মূল্যায়নও নেই। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিক্য ও  বিনিয়োগ বাড়ছে, তাদের বড় অংশ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। প্রার্থীর আদর্শ, দর্শন ও ব্যক্তিত্বের চেয়ে দলীয় প্রতীকের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জনগণের একটা অংশ রাজনীতি ও নির্বাচন-বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের কাছে নির্বাচনের গুরুত্ব কমে আসছে।

তিনি আরও বলেন, নিরপেক্ষতার বড় কোনো নজির না থাকায় নির্বাচন কমিশন, সিভিল প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়েও এক ধরনের বিতর্ক রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, সরকারের অধীনে থেকেও নির্বাচন কমিশন চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে বর্তমান কমিশন আস্থা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে না।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণ ৫ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে নির্বাচনের জন্য। জনগণের একটি বড় অংশ খুব করে চায় ভোটের ফলাফলে তাদের মত প্রতিফলিত হোক। সবসময় তেমনটি হয় না বা হয়ে ওঠে না, অথবা হতে দেওয়া হয় না।

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে ভোটারদের কারও কারও মনে নানা শঙ্কা বাসা বেঁধেছে। এসব শঙ্কা থেকে জনগণকে বের করে আনার দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের যদি কোনো আস্থার সংকট থেকে থাকে, তবে সেখান থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে।’

যা বলছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা

রংপুরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাহববু আলম শাহ্ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা, বিপরীতে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়-দায়িত্ব প্রার্থীদের। তবে ভোটারদের ভোট দেওয়ায় উৎসাহিত করতে আমরা বিভিন্নভাবে সচেতনতামূলক কাজ করে আসছি। 

এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী-সমর্থক কিংবা সন্ত্রাসীরা মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভয়ভীতিহীন নির্বাচন ও ভোটের নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দায়িত্ব পালনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত। ভোটার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, নির্বাচনী এজেন্ট, গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর। কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আরএআর