নিহত সানজিদা আক্তার রুমি

প্রেমের সম্পর্ক করে পালিয়ে বিয়ে করেন সানজিদা ও জুয়েল। পরবর্তীতে দুই পরিবার তাদের বিয়ে মেনেও নেয়। কিন্তু সানজিদার অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে তাদের আট মাসের দাম্পত্য জীবন। সানজিদার মৃত্যুর ঘটনায় স্বামী জুয়েলকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছেন নিহতের ভাই ইমদাদুল হক। এখন মামলাটির তদন্ত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের জন্য থমকে আছে। 

পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেতে অন্তত আড়াই মাস সময় লাগে। প্রতিবেদন না পেলে তদন্ত কাজে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

গত শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পিড়াপাট এলাকার স্বামীর বাড়ি থেকে সানজিদা আক্তার রুমির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই সময় স্বামী জুয়েল পলাতক ছিলেন। দুপুরের দিকে সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে আটক করে পুলিশ। রাতে মামলা হলে তাকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার অপর আসামি জুয়েলের মা জহুরা খাতুন (৪৫)। তিনি পলাতক রয়েছেন।

জুয়েল (২৪) কাহালুর পাইকড় ইউনিয়নের পিড়াপাট গ্রামের সাহিদুল ইসলামের ছেলে। তিনি রডমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। আর তার স্ত্রী সানজিদা আক্তার রুমি (১৯) সদর উপজেলার দাঁড়িয়াল গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলীর মেয়ে।

মামলার বাদী দাঁড়িয়াল গ্রামের সানজিদার ভাই ইমদাদুল হক। তিনি ইলেকট্রিক সামগ্রীর ব্যবসা করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, যৌতুকের জন্য সানজিদাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। 

মামলার এজাহারে জানা গেছে, বিয়ের পর সানজিদা প্রায় ২ থেকে ৩ মাস স্বামীর সংসারে সুখে শান্তিতে ছিলেন। তারপর থেকে যৌতুকের টাকা ও বাবার সম্পত্তির অংশ নেওয়ার জন্য সানজিদার ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শুরু হয়। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করায় সানজিদা এসব মুখ বুজে সহ্য করতেন। বাবার বাড়ির কাউকে জানাননি। কিন্তু একপর্যায়ে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গত মাসে বাড়িতে সব খুলে বলেন সানজিদা। এ ঘটনায় ১৬ আগস্ট সানজিদার স্বজনেরা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের সঙ্গে কথা বলেন। সমঝোতা করে সানজিদাকে আবার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পরে ৩১ আগস্ট রাত ৮টার দিকে সানজিদা ফোন দিয়ে জানায় তার ভাগের সম্পত্তি ও যৌতুক না দিলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমন কথার পরদিন সানজিদার মৃত্যুর খবর পায় পরিবার। খবর পেয়ে সানজিদার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে মরদেহের ডান পায়ের আঙুলে আঘাতের চিহ্ন ও রক্ত দেখতে পান তার ভাই। 
  
সানজিদার ভাই ইমদাদুল হক বলেন, সানজিদা সবেমাত্র নবম শ্রেণিতে উঠেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিয়ে করে সে। কবে থেকে বা কীভাবে তার প্রেম হয়, আমরা কিছুই জানতাম না। তবে বিয়ে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পর থেকে যৌতুকের জন্য তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়। এটার জন্য আমরা পারিবারিকভাবে তাদের বুঝিয়েছি। কিন্তু এরই মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে গেল।  

মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুনছি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসতে দেরি হয়। এ জন্য নাকি তদন্ত কাজও পিছিয়ে পড়ে। আবার আসামিপক্ষ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে অনৈতিক সুবিধা নিতে পারে এমন ভয়ও হচ্ছে।  

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাহালু থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রুবেল প্রামানিক বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে আর্থিক সংকট থেকে জুয়েল ও সানজিদার দাম্পত্যে টানাপোড়ন চলছিল। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-কলহও হতো। 

সানজিদার মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, সানজিদার মৃত্যুর বিষয়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া কিছুই বলা যাবে না। প্রতিবেদনের জন্য বসে আছি। এটি না আসলে তদন্তও করা সম্ভব না। সাধারণত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসতে অনেক সময় লাগে। সানজিদার ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন চার মাসের আগে হাতে আসবে না। 

কাহালু থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদ হাসান বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনটাই আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগায়। কোনো প্রতিবেদন দুই-আড়াই মাসের আগে পাওয়া যায় না। এখনো কাহালু থানায় অন্তত ১০টি মামলা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছে। প্রতিবেদন আসলেই তদন্তকাজ শেষ করে দেওয়া যায়। না আসা পর্যন্ত বসে থাকা লাগে। এখানে ফরেনসিক বিভাগকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওখানে যেমন কাজের চাপ, তেমনি চিকিৎসক সংকটও আছে। 

এ বিষয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমাদের এ বিভাগে লোকবল সংকট একটি বড় সমস্যা। নতুন করে আরও একজন শজিমেকের ফরেনসিক বিভাগে পদায়ন হয়েছেন। তারপরও কাজের চাপ লেগে থাকে। আবার অনেক ময়নাতদন্তে বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষায় সময় লাগে। 

ময়নাতদন্তে দীর্ঘসূত্রিতা মামলার কাজকে বাধাগ্রস্ত করে কিনা জানতে চাইলে ডা. মিজানুর রহমান বলেন, সব মামলায় ময়নাতদন্তের ওপর নির্ভর হতে হয় এমন কিন্তু না। অনেক মামলা আছে যেখানে সাক্ষী ও অন্যান্য প্রমাণ দিয়ে তদন্ত কাজ করা যায়। অপমৃত্যুগুলোর ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত প্রয়োজনীয়। তবে আমরা সবসময় চেষ্টা করি দ্রুত প্রতিবেদন দেওয়ার।

ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ফরেনসিক বিভাগে চিকিৎসকদের আগ্রহ কিছুটা কম দেখা যায়। এ কাজটা অধিকাংশ চিকিৎসক করতে চান না। এখানে কাজ করতে গেলে অনেক সময় চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। 

আরএআর